তারতিলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত জরুরি

11
299

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রাথমিকভাবে নবী সা:-কে যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে আদেশ দিয়েছেন তার প্রথম আদেশ হলো ইবাদত। যেমন সূরা মুজাম্মিলে প্রথমে রাসূলুল্লাহ সা:-কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সম্বোধন করেছেন, ‘বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি’ বলে। তার পরেই বলা হলো, ‘রাত্রি জাগরণ করো রাতের কিছু অংশ বাদ দিয়ে। অর্ধ রাত্রি বা তদপেক্ষা অল্প কিংবা তার চেয়ে বেশি। কুরআন আবৃত্তি করো ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী।’ এই আয়াতে তারতিলের কথা বলা হয়েছে।

তারতিলের মূল উদ্দেশ্য যথাযথভাবে কুরআনের হক আদায় করে কুরআন তিলাওয়াত করা। কুরআন কারিমের হক সম্পর্কে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালার বাণী, ‘আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি (তাদের মধ্য থেকে) যারা তার হক আদায় করে তিলাওয়াত করে তারাই এই কিতাবকে বিশ্বাস করে। আর যারা একে অস্বীকার করে, তারাই হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত লোক।’ (সূরা বাকারা : ১১২)

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘ইয়াতলুনা হাক্কা তিলাওয়াতিহি’- তারা তা যথাযথভাবে অনুসরণ করে। রাত্রি জাগরণের মর্মকথা হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদতের প্রথম দাবি পবিত্র কুরআন বোঝা ও মানা। কুরআনের আদেশ-নিষেধ জানা বোঝা ও মানার জন্য প্রয়োজন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে তা তিলাওয়াত করা। এ জন্য প্রয়োজন সহিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা। সহিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত না করলে অর্থের পার্থক্য হতে পারে, আর এ কারণে আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন তার তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হবে না। কুরআন মজিদের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করে কুরআন আবৃত্তি করা হলে, আপনা থেকেই তিলাওয়াতকারীর চোখে পানি এসে যাবে। যেমন : রাসূলুল্লাহ সা: এক ব্যক্তিকে কুরআন তিলাওয়াত করার সময় ক্রন্দন করতে দেখে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যে তারতিলের কথা বলেছেন এটা সেই তারতিল’।

কুরআনের হক বা দাবি হচ্ছে, তারতিলসহকারে তিলাওয়াত করা এবং একই সাথে তার আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করা। ২০১৩ সালে আরব বসন্তের পরে; আমার মেঝো ভাইয়ার সাথে ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র রমজান মাসে বায়তুল্লাহ শরিফে গিয়েছিলাম। একই সাথে আমার ভাতিজীও ওমরাহ করতে গিয়েছিল। আমরা যখন কিয়ামুল লাইলে অংশ নিতাম, তখন মনে হতো এমন একটি অপার্থিব জগতে আমরা অবস্থান করছি তার সাথে তুলনা করা যায় এমন কিছু কি এ জগতে আছে? বায়তুল্লাহ শরিফের ইমাম সাহেবানদের মনোহর তিলাওয়াতের সুগভীর আবেগ তাদের যেমন কাঁদিয়েছে, তেমনিভাবে লাখ লাখ মুসল্লির আর্তহাহাকারের ফোঁপানো শব্দে উচ্চকিত হতো কাবা শরিফের আকাশ-বাতাস। এরই নাম তারতিল।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র আল কুরআনকে ভারী কালাম বা গুরুভার বাণী বলে উল্লেখ করেছেন। তাফসির ইবনে কাসিরে, ইসনে কাসির লিখেছেন, ‘কুরআনের কথা আমি তোমার ওপর নাজিল করেছি গুরুভার বাণী অর্থাৎ তা আমল করতেও ভারী হবে এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও বৃহত্তর কারণে অবতীর্ণ হওয়ার সময়ও তা কষ্টদায়ক হবে।’ যেমন : জায়িদ ইবনে সাবিত রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘একদা রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর অহি অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাঁর উরু আমার উরুর ওপরে ছিল। তখন অহির বোঝা আমার ওপর এমন ভারী বোধ হলো যে, আমার ভয় হলো না জানি আমার উরুই ভেঙে যায়।’

আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হারিস ইবনে হিশাম রা: জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা:। অহি অবতীর্ণ হওয়ার সময় আপনি কিছু অনুভব করেন কি? রাসূলুল্লাহ সা: উত্তরে বলেন, ‘আমি এমন কিছু শব্দ শুনতে পাই, যেমন গুন গুন শব্দ হয়। যখনই অহি অবতীর্ণ হয় তখন তা আমার ওপর এমন ভারী বোঝাস্বরূপ হয় যে, আমার মনে হয় যেন আমার প্রাণই বেরিয়ে যাবে’। (আহমদ : ২/২২২)।
উপরিউক্ত হাদিসগুলো থেকে জানা এবং বোঝা যায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এই বাণীর মমার্থ এবং গুরুত্ব এতটাই ব্যাপক বিস্তৃত, যা বিশ্বের অন্য কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ধর্ম প্রচারকের বাণীর সাথে কোনোকালেই তুলনীয় হতে পারে না।
আঞ্চলিকতার সীমানা পেরিয়ে আল কুরআন তাঁর সীমাহীন পক্ষপুটের নিচে পুরো বিশ্বমানবতাকে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানায়। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী :
‘হে মানুষ। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে এবং আমি তোমাদের কাছে এমন আলো পাঠিয়েছি, যা তোমাদের সুস্পষ্ট পথ দেখায়। অতএব, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তার ওপর দৃঢ়তা অবলম্বন করেছে তিনি তাদের স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের আশ্রয়ে স্থান দেবেন এবং তার দিকে আসার মতো সরল পথে পরিচালিত করবেন।’ (সূরা নিসা : ১৭৪-১৭৫)।

এখানে জাত-পাত, কালো-ধলো এবং ধনী-দরিদ্রের কোনো ব্যবধান নেই। এখানে যে বা যারা আল্লাহ তায়ালার গুরুত্বপূর্ণ বাণীর প্রতি আস্থা রেখে নুরুম্মুবিনের পথে চলতে চাইবেন, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাদের স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের ছায়ার নিচে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেবেন। ভারী কালাম বা ওজনদার বাণীর তাৎপর্য মানুষ যতখানি জানতে ও বুঝতে পারবে ততখানিই তার বা তাদের মন-মগজ থেকে তা উৎসারিত হয়ে থাকে বা হতে থাকবে।

11 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here