অদৃশ্য ইন্টারনেট (Internet of Things) ও আগামীর পৃথিবী

13
296
Internet_of_Things.svg

২০৩০ সালের হেমন্তের এক মিষ্টি সকাল। হাতে পরিধান করা স্মার্ট ঘড়ি (Smart Watch) টির মৃদু কম্পনে ঘুম ভাঙল সজলের। অফিস বন্ধ তাই ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সজল। হঠাথ ঘুম ভাঙায় অবাক হলেন এবং ঘড়ির মনিটরে দৃষ্টি দিতেই খেয়াল করলেন সকাল ১০ ঘটিকায় অফিসে জরুরি সভা ডেকেছেন বস। তৈরি হয়ে অফিসে পৌঁছাতে মোট দুই ঘণ্টা সময় লাগবে তাই ৮ টার সময় ঘুম ভাঙিয়ে দিল স্মার্ট ঘড়ি। দাঁত ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দাই দাড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে কিছুটা আনমনে হয়ে গেলেন সজল। ততক্ষণে স্মার্ট শেভার (Smart Shaver) থেকে সতর্কবার্তা (Alarm) আসল, বুঝতে পারলেন সময় চলে যাচ্ছে এবং আজকে তাকে শেভ করে অফিস যেতে হবে। তাই সময় নষ্ট না করে শেভ করতে চলে গেলেন। শেভ সেরে গোসল করে তৈরি হতে না হতেই কফি মেকার (Coffee Maker) থেকে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ ভেসে আসল। বুঝতে পারলেন তার কফি তৈরি। কফি পান করে বাসা থেকে বের হতে যাচ্ছেন এমন সময় তার স্মার্ট ছাতা (Smart Umbrella) থেকে সতর্ক বার্তা তার কানে আসল। বুঝতে পারলেন বৃষ্টি হতে পারে তাই ছাতা নিয়ে বের হউয়া উচিৎ।

বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ির মনিটরে বার্তা আসলো, যে রাস্তা দিয়ে তিনি যেতে চাচ্ছেন সে রাস্তায় যানজট রয়েছে এবং দুই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যেতে পারে এবং তিনি যদি ডানদিকের রাস্তা অনুসরণ করেন তবে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পাড়বেন। তাই চিন্তা না করে ডান দিকের রাস্তা অনুসরণ করলেন এবং সময়মত অফিসে পৌঁছালেন।

রাত ৮ টা। সারাদিন কর্ম ব্যস্ত সময় পার করে বাসায় ফিরছেন সজল সাহেব। আর কিছুদূর এগিয়ে ডানের ওড়াল সেতুর উপর উঠবেন। এমন সময় গাড়ির মনিটরে একটি সতর্ক বার্তা আসলো। চালক খেয়াল না করে এগিয়ে চললেন। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়িটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এবার মনিটরে দৃষ্টি দিলেন চালক। বুঝতে পারলেন সামনের ওড়াল সেতুটি ইতোমধ্যে  ওভার লোড হয়ে গেছে। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

 

ইন্টারনেট অফ থিংগস (Internet of Things) হল এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে আমাদের আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস গুলো একে অপরের সাথে নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে এবং আমাদের কোন নির্দেশনা ছাড়াই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করবে এবং তথ্য আদান প্রদান করবে। এর মধ্যে থাকতে পারে বাসার লাইট, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ, ওয়াসিং মেশিন, রাইছ কুকার, কফি মেকার, মোবাইল ফোন, আপনার চেয়ার, টেবিল, চাবির রিং, মানিব্যাগ এবং আপনি যা যা চিন্তা করতে পারেন সবকিছু (The only limit is your imagination)। ইন্টারনেট অফ থিংগস এর সুবাদে আপনি কোনোকিছু দূর থেকে মনিটর এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যেমন আপনি অফিস বসে আপনি আপনার বাসার পানি তুলার মোটর চালু করে দিতে পারবেন। আপনার বাচ্চা কোথায় আছে এবং কি করছে তা মনিটর করতে পারবেন। আপনি আপনার স্মার্ট ফোন থেকে আপনার বাসার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি অন অফ করতে পারবেন।

ইন্টারনেট অফ থিংগস এর সঠিক বাংলা করলে অর্থটা হয় “বস্তুর ইন্টারনেট”। ব্রিটিশ উদ্যোক্তা কেভিন অ্যাস্টন ( Kevin Ashton) ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট অফ থিংগস কে ইন্টারনেট অফ স্মার্ট থিংগস অথবা ইন্টারনেট অফ এভরিথিং ও বলা হয়। ইন্টারনেট যেমন আমাদের জীবনযাত্রাই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল ঠিক সেভাবেই ইন্টারনেট অফ থিংগস অবিলম্বে আমাদের জীবনে  আরেকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট অফ থিংগস এর আওতাই সংযুক্ত ডিভাইসের সংখ্যা হবে ৩০ লক্ষ কোটি  (30 billion)। ইউকে  সরকার তাদের ২০১৫ সালের বাজেটে শুধু ইন্টারনেট অফ থিংগস বিষয়ক গবেষণার জন্য বরাদ্ধ রেখেছে ৪ কোটি ডলার।

যেভাবে কাজ করবে ইন্টারনেট অফ থিংগস

কোন একাটি নেটওয়ার্ক এর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য নেটওয়ার্কের অন্তর্গত প্রত্যেকটি ডিভাইসের একটি অনন্য নাম বা আইডি (Unique address) দরকার। এই অনন্য আইডিকে বলা হয় IP address. আমরা বর্তমানে যে আই পি এড্রেস ব্যাবহার করছি এটা হল আই পি ভার্সন ৪। আই পি ভার্সন ৪ এ ৪.৩ বিলিয়ন অনন্য আইডি হতে পারে। ইন্টারনেট অফ থিংগস এ লক্ষ কোটি ডিভাইসকে সংযুক্ত করতে হলে আমাদেরকে আই পি ভার্সন ৬ এ যেতে হবে যার মাধ্যমে এই পৃথিবীর সকল অনু পরমাণু কে একটি করে অনন্য আইডি দেয়া সম্ভব!

Internet_of_Things.svg

ইন্টারনেট অফ থিংগস এর আর একটি অন্যতম উপাদান হল বিভিন্ন ধরনের সেন্সর। যে সেন্সর গুলো প্রতিনিয়ত পরিবেশ থেকে ডাটা গ্রহন করবে, ডাটা গুলো ক্লাউড সার্ভারে পাঠাবে। ক্লাউড সার্ভার প্রপ্ত ডাটা প্রসেস করবে এবং এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিভিন্ন ডিভাইসে পাঠাবে এবং প্রয়োজন বোধে সংরক্ষন করবে। লক্ষ কোটি সেন্সর থেকে প্রাপ্ত ডাটা সাইজ হবে বর্তমান ডাটার থেকে অনেক বেশি। বর্তমানে ইন্টারনেটে সঞ্চিত ডাটার পরিমান হল আনুমানিক ৫০০ এক্সাবাইটের বেশী (1 EB = 10006bytes = 1018bytes = 1000000000000000000B = 1000 petabytes = 1million terabytes =1 billion gigabytes.)। ২০২০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট অফ থিংগস এর মাধ্যমে প্রতিদিন শতশত এক্সাবাইট ডাটা ইন্টারনেটে যুক্ত হবে। এই বিশাল ডাটাকে বলা হবে বিগ ডাটা।

যেমন, এমন একটি শহেরের কথা চিন্তা করুন, যেখানে শহরের প্রতিটি গাড়ি নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে। প্রতি গাড়ি তার অবস্তান, প্রত্যাশিত গন্তব্য এবং রাস্তা ইত্যাদি  পাঠাবে স্থানীয়  স্টেশনে, প্রত্যেকটি স্থানীয়  স্টেশন আবার সেই ডাটা পাঠাবে কেন্দ্রীয়  স্টেশনে। কেন্দ্রীয়  স্টেশন প্রাপ্ত ডাটাগুলো বিশ্লেষণ করে কোন রাস্তায় কি পরিমাণ যানবাহন আছে, কোন রাস্তায় যানজট হতে পারে, কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে কিনা, কোথায় কোথায় পার্কিং খালি আছে, কোন গাড়িটা কোন সময়ে কোন স্টেশনে পৌঁছাবে ইত্যাদি বের করবে এবং সে অনুযায়ী বাবস্থা নেবে। যেমন কোন রাস্তাই কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এই রাস্তাগামী গাড়িগুলোকে আগে থেকেই জানিয়ে দেবে বিকল্প রাস্তা অনুসরন করার জন্য। বাস স্টেশনে থাকা মনিটর থেকে দেখা যাবে কোন গাড়িটি কোথায় আছে, কোথায় যাবে এবং স্টেশনে পৌঁছাতে আর কত সময় লাগবে ইত্যাদি।

 

কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হবে এই ইন্টারনেট অফ থিংগস 

অদূর ভবিষ্যতে ইন্টারনেট অফ থিংগস এর ব্যাবহার হবে সর্বব্যাপী। গৃহস্থালি, শিল্প কারখানা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় ইন্টারনেট অফ থিংগস ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হবে। নিচে কিছু উদাহরন দেয়া হল।

jsan-01-00217-ag

স্বয়ংক্রিয় বাড়ি

স্বয়ংক্রিয় বাড়ি (Home Automation) হল এমন একটি বাড়ি যেখানে সবকিছু স্বয়ংক্রিয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। যেমন ধরুন, আপনি বাসায় প্রবেশ করার সাথে সাথে লাইট, ফ্যান চালো হয়ে যাবে। বাসায় সবসময় একটি আরাম দায়ক তাপমাত্রা থাকবে, আপনি পড়ার টেবিলে বসলে টেবিল ল্যাম্প চালো হয়ে যাবে, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে আপনার জানালার পর্দা গুলো সরে যাবে, আপনি হাত মুখ ধুতে ধুতে আপনার জন্য কফি তৈরি হয়ে যাবে, রাতে কোন কারনে ঘুম থেকে উঠলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে লাইট জ্বলে উঠবে, চোর আসলে কিংবা আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম বাজবে। আপনার কাপড় ময়লা হয়ে গেলে ওয়াশিং মেশিন আপনাকে অনুরুধ জানাবে কাপড় ধোয়ার জন্য। আপনি বাজারে যাচ্ছেন, আপনার স্মার্ট ফ্রিজ আপনাকে জানিয়ে দেবে কি কি আনতে হবেয।কোনটা ফুরিয়ে গেছে, কোনটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ইত্যাদি।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

মনে করুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় পা পিছলে পড়ে গেলেন। আপনার হার্ট বিট বেড়ে গেল। আপনার হাতে থাকা স্মার্ট ব্যান্ড অথবা স্মার্ট ঘড়ি আপনার হার্ট বিট মনিটর করে দেখল অস্বাভাবিক। সে আপনার হার্ট বিট, তাপমাত্রা, রক্ত চাপ, আপনার অবস্তান পাঠিয়ে দেবে আপনার ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সে গুলো যাচাই করে যদি মনে করেন গুরুতর তবে তিনি অ্যাম্বুলেন্স কল করবেন। অ্যাম্বুলেন্স আপনাকে সেখান থেকে হাসপাতাল নিয়ে আসবে।

 

আমি শুরু করেছিলাম একটি গল্প দিয়ে। এটা কোন কল্পিত গল্প কিংবা হলিউড সিনেমার কোন দৃশ্য নয়। এর অনেক গুলো ইতমদ্ধে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাঁকি গুলো খুব শিগ্রই বাস্তবায়িত হবে। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মনে করুন সজল সাহেবের বস সভার বিষয়ে সজল সাহেবকে একটি ই মেইল করলেন দিন তারিখ উল্লেখ করে। সজল সাহেবের কম্পিউটার অথবা মোবাইল ফোন সেটা প্রসেস করে স্মার্ট ঘড়িতে পাঠাল। স্মার্ট ঘড়ি সে হিসেবে সজলকে উঠিয়ে দিল। সজল ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে স্মার্ট ঘড়ি শেভারে মেসেজ পাঠাল। শেভার সে হিসেবে এলার্ট বাজাল। শেভিং শেষে শেভার বার্তা পাঠাল কফি মেকারের কাছে। সজল যখন গোসল করছিলেন  ততক্ষণে কফি মেকার কফি তৈরি করেছে। স্মার্ট ছাতা ইন্টারনেট থেকে আবহাওয়া বার্তা পর্যবেক্ষণ করে বুঝল যে  দিল যে বৃষ্টি হতে পারে এবং সে অনুযায়ী এলার্ম বাজাল।

একি ভাবে সজল যখন উড়াল সেতুতে উঠতে যাবে তখন উড়াল সেতুর সাথে সংযুক্ত সেন্সর গুলো লোড হিসেব করে দেখল যে আর বেশি গাড়ি উঠা বিপদজনক। সে বার্তা পাঠিয়ে দিল গাড়িতে। গাড়ি প্রথমে সতর্ক বার্তা দিল এবং পড়ে স্টার্ট বন্ধ করে দিল কারন তা না হলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

উপরের উদাহরন গুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, অধিকাংশ কাজ হচ্ছে আমাদের কোন সাহায্য ছাড়াই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আমরা এটা বুঝতেই পারবনা যে ডিভাইস গুলো একে অপরের সাথে ইন্টারনেট এর মাধ্যমে সংযুক্ত। ইন্টারনেট এখানে অদৃশ্য ভূমিকা পালন করবে। তাই আমি এর বাংলা করেছি অদৃশ্য ইন্টারনেট।

ইন্টারনেট অফ থিংগস (IoT) এর সফলতার পিছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে মাইক্রোসফট, ইন্টেল গুগল এবং অ্যামাজনের মতো  কোম্পানি। মাইক্রোসফট তাদের উইন্ডোজ ১০ এর IoT সংস্করণ অবমুক্ত করেছে। ইন্টেল অবমুক্ত করেছে তাদের নতুন হার্ডওয়্যার ইন্টেল এডিশন (Intel Edison)। অ্যামাজন চালো করেছে IoT ক্লাউড সার্ভিস AWS এবং IoT বাটন

একটি অধিক সুন্দর এবং অধিক স্মার্ট পৃথিবী আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই চলুন আমরা নিজেদেরকে আরও স্মার্ট করে গড়ে তুলি এবং পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাই। একটি স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতীক্ষায়… … …

13 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here