সত্যিকারের পাইরেটসদের নিয়ে পনেরোটি অবাক করা তথ্য!

9
330

জলদস্যুদের নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে, রচিত হয়েছে ট্রেজার আইল্যান্ড-এর মতো উপন্যাস। পাইরেটদের নিয়ে যত গল্প, কাহিনী তার বেশিরভাগ মূলত ১৭, ১৮ শতকের দিকের ক্যারিবিয়ান পাইরেটদের। বিভিন্ন চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে তাদের নিয়ে। হলিউডে নির্মিত ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ চলচ্চিত্রের খ্যাতি তো বিশ্বব্যাপী। চলুন জেনে নেওয়া যাক পাইরেটদের নিয়ে কয়েকটি অবাক করা তথ্য।

১৫ জলদস্যুদের স্বর্গ

আঠারো শতকে ‘নাসাউ’ ছিল জলদস্যুদের স্বর্গ। ‘নাসাউ’ বাহামার বড় একটি শহর। বাহামার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এ শহরে বাস করতো। তখন এ এলাকাটা ছিলো ব্যবসাবাণিজ্যের আতুরঘর। ১৭০০ সালের শুরুতে নাসাউ’তে কোন সরকার ছিলো না, কার্যতই কোন আইন-কানুনও ছিলো না। এসময় ‘নাসাউ’ শহর পাইরেটদের রাজ্যে পরিণত হয়। ধারণা করা হয়- এলাকাভিত্তিক পাইরেটস বাদে এখানে প্রায় ১০০০ পাইরেট ছিলো। পাইরেটরা এ শহরের নাম দেন পাইরেটস রিপাবলিক। একই সাথে ঘোষণা দেয় তারাই এ অঞ্চলের শাসক। পরবর্তীকালে আঠারো শতকের শেষের দিকে বৃটিশরা নাসাউ-এর নিয়ন্ত্রন নেয়।

১৪ ব্ল্যাকবিয়ার্ড

পাইরেটদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত একজন পাইরেট হলো ব্ল্যাকবিয়ার্ড। চার্লস ভেইন, অ্যান বনি, বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড, এন্ড ক্যালিকো ছিল নামকরা পাইরেট। এদের মধ্যে ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিল সবচে দুর্ধর্ষ এবং কুখ্যাত। সে নিজের নামকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করেছিল। সে ছিল বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের শিষ্য। বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড অবসর নেয়ার পর এডয়ার্ড টেক তথা ব্ল্যাকবিয়ার্ডের আধিপত্য শুরু হয়। ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিল ক্ষমাহীন, নির্দয়। তবে অনেকেই মনে করে থাকেন, ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ভয়ানক কর্মকান্ডগুলোকে বিভিন্ন উপন্যাসে আরো ভয়ানক হিসেবে তুলে ধরে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। কারণ ব্ল্যাকবিয়ার্ড কখনোই তার বন্দীদের হত্যা করেনি।

১৩ জলি রজার 

পাইরেটরা যে প্রতীক ব্যবহার করতো তার নাম জলি রজার। এটি একটি সাদা মাথার খুলি এবং ক্রসবোন সংবলিত প্রতীক যার পেছন দিকে কালো রঙ ব্যবহার করা হত। মূলত এটিই তাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বিভিন্ন পাইরেট (ক্যাপ্টেন) নিজেদের আলাদা পরিচিতির জন্য এটা পরিবর্তন করতো।

১২। ব্ল্যাক বার্ট

বার্থোলোমিউ রবার্টস ওরফে ব্ল্যাক বার্ট ছিল সবচেয়ে সফল পাইরেট। ব্ল্যাক বার্ট ছিল নির্ভয়, সাহসী এবং শৌখিন এক পাইরেট। সবসময় সে দামি জামাকাপড় এবং অলংকার পরিহিত অবস্থায় থাকতো। কে কত বেশি জাহাজ অপহরণ করতে পারে তার উপর পাইরেটদের ক্ষমতা বিচার করা হতো। সে হিসেবে ব্ল্যাকবার্টের কাছাকাছি মানের কোন পাইরেটও ছিল না। ব্ল্যাক বার্ট প্রায় ৪০০ জাহাজ অপহরণ করেছিল! পাইরেট হিসেবে তার রাজত্ব ছিল ১৭১৯ থেকে ১৭২২ সাল পর্যন্ত। তার ইচ্ছে ছিল সে যুদ্ধরত অবস্থায় যেন মারা যায়, হয়েছিলও তাই। পরে তার অনুসারীরা তাকে তার ইচ্ছানুযায়ী সাগরে সমাহিত করে।

১১। পাইরেটদের বিশ্বাস

পাইরেটরা সবসময় কানে দুল পরতো, তাদের ধারণা ছিল কানের দুল তাদের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এমনকি অনেক পাইরেটের বিশ্বাস ছিল কানের দুল অন্ধত্ব থেকেও রক্ষা করে। কানের দুলের সাথে স্মৃতিরক্ষার একটা সম্পর্কেও তারা বিশ্বাস করতো। বেশিরভাগ পাইরেট’স ক্যাপ্টেন লোক দেখানোর জন্য দামি জামাকাপড় এবং গহনা পরতো। কারন এটা দ্বারা বোঝা যেত কে কত বেশি জাহাজ অপহরণ করেছে, আর যে যত বেশি জাহাজ অপহরণ করেছে, সে তত বেশি শক্তিশালী। বিপজ্জনক জলসীমায় গিয়ে তারা জীবন রক্ষাকারী কবজ পরতো, তারা মনে করতো এটা তাদের জাহাজকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে। অবশ্যই এগুলো ছিল কুসংস্কার।

১০। নারী পাইরেটস 

সতেরশ-আঠারোশ শতকে নামকরা সব পুরুষ পাইরেটদের ভিড়ে নারী পাইরেটরাও রাজত্ব করেছে। সবচে পরিচিত পাইরেটদের মধ্যে অন্যতম ছিল- চেং আই সাও, মেরি রেড এবং কুখ্যাত এনি বনি। এনি বনি ছিল সম্ভ্রান্ত আইরিশ আইনজীবীর অবৈধ সন্তান। এনি বনি ছোটবেলায় ছেলেদের মতো পোশাক পরে থাকত তার বাবার ক্লার্ক হিসেবে কাজ করার জন্য। ক্যাপ্টেন ক্যালিকো জ্যাকের সাথে এনি বনির ছিল দারুণ এক প্রেমের সম্পর্ক। কথিত আছে, এনি বনি অত্যন্ত সাহসী ছিল এবং ক্ষিপ্ত মেজাজের অধিকারী ছিল। যদি কোন পুরুষ তার উপর জোর করতো সে তাদের কঠিন শাস্তি দিতো।

৯। আই প্যাচ 

দৃষ্টি ঠিক রাখার জন্য তারা চোখে ‘আই প্যাচ’ পরতো। আই প্যাচ হচ্ছে এক ধরনের বস্তু যা পরার পর দেখতে সুবিধা হতো শত্রুপক্ষ তাদেরকে আক্রমন করছে, কী করছে না! জাহাজের ডেকের তলদেশে দেখতেও সুবিধা হতো। পাইরেটদের আই প্যাচ পরার থিওরি যদিও একটি কল্পকাহিনীর মতো। তবে এটাকে সত্য বলেও ধারণা করা হয় কারন বর্তমানের এয়ারক্রাফট পাইলটরাও এ ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

৮। জাহাজের নিয়ম 

পাইরেটদের প্রতিটি আলাদা জাহাজে তাদের নিজেদের নিয়ম জারি ছিল। প্রতিটি জাহাজের জন্য একজন কোয়ার্টার মাস্টার এবং ক্যাপ্টেন থাকতেন। সেই ক্যাপ্টেনের নিজেদের তৈরী নিয়মে সেই জাহাজ চলাচল করতে হতো। তবে সবগুলো জাহাজকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতেই হতো। খাদ্য কিংবা লুট করা ধনসম্পত্তির সঠিক ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একই নিয়ম মেনে চলতো।

৭। পাইরেটদের চরিত্র 

সব পাইরেট যে খুনি ছিল তা নয়। পাইরেটদের যখন সোনালী সময় চলছিল, শহরের ভালো মানুষের জন্য তখন ছিল ভয়ানক সময়। ভালো মানুষগুলোও তখন বাধ্য হয়ে পাইরেট হয়ে যায়। তারা শুধুমাত্র খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য পাইরেসি শুরু করে। উইলিয়াম কিড ছিল তেমন একজন পাইরেট, যে ‘ক্যাপ্টেন কিড’ নামে পরিচিত ছিল। ক্যাপ্টেন কিড জন্মগ্রহণ করে সম্ভ্রান্ত এক স্কটিশ পরিবারে। পাইরেট হিসেবে কুখ্যাত হলেও সে তার সাগর জীবন শুরু করে পাইরেট হান্টার হিসেবে।

৬। পাইরেটদের ধনসম্পত্তি

প্রচলিত আছে পাইরেটরা তাদের ধন-সম্পত্তি লুকিয়ে রাখত, এটা অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য কারন সবাই ছিল ঘোরতর অপরাধী, ধরা পড়ার ভয়ে এবং ধনসম্পত্তি হারানোর ভয়ে তারা তা লুকিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে কোন পাইরেট ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রাখেনি। শুধুমাত্র উইলিয়াম কিড একবার ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিল। সে চেয়েছিল সে ধরা পড়ার পর তার লুকিয়ে রাখা ধনসম্পত্তি বিনিময়ে জীবন বাঁচাবে। কিন্তু এটা কোন কাজে আসেনি। তাঁকে পাইরেট হিসেবেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

৫। পাইরেটদের শাস্তি

কথিত আছে ‘ওয়াকিং দ্য প্ল্যাঙ্ক’ ছিল পাইরেটদের দেয়া প্রচলিত শাস্তি। কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবে সত্য নয়। যখন কোন ঘোরতর অপরাধীকে সাজা দেওয়া হতো, তখন এই শাস্তি দেয়া হতো। এবং সেটাও দেয়া হতো বিশেষ কোন অনুষ্ঠানের সময়, জাহাজের অন্যান্য সদস্যদের আনন্দ দেয়ার জন্য। তারা অপরাধীর হাত-পা বেঁধে দিতো যেন সাঁতার কাটতে না পেরে তারা মারা যায়।

৪। বিশ্বব্যাপী পাইরেটদের রাজত্ব 

আমাদের ধারণা পাইরেটদের রাজত্ব শুধুমাত্র ক্যারিবিয়ানকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু তারা সারা পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব কায়েম করেছিল। প্রায় প্রতিটি সাগরের আলাদা-আলাদা পাইরেটদের নানা কাহিনী রয়েছে। কুখ্যাত ‘বারবারাসা ব্রাদার্স’ মেডেস্টেরিয়ান সমুদ্রে ইউরোপের জাহাজগুলো আক্রমন করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টে তাদের রাজত্ব ছিল, অবশেষে শুধু তাদের ধ্বংস করতেই পোপ একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে। ১৫৫৭ সালে ইংল্যান্ডের রানী ব্যক্তিগতভাবে ‘স্যার ফ্রান্সিস ড্রেইক’ নামক নাবিককে ভাড়া করে স্প্যানিশ পাইরেটদের ধ্বংস করতে। চীনদেশের কুখ্যাত পাইরেটদের মধ্যে অন্যতম ছিল মাদাম চেং। মাদাম চেং-এর স্বামীর পাইরেসির বিশাল ইতিহাস রয়েছে। কথিত আছে, মাদাম চেং ১৮০০-এর বেশি জাহাজ এবং ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের এক বাহিনী তৈরী করেছিল।

 সাধারণ পাইরেট 

কথায় আছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। তেমনটাই ঘটেছিল সে সময়ের সাধারণ ভালো মানুষের ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেলে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগীতা করতে না পেরে অনেকেই পাইরেসিকে অর্থ উপার্জনের বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়।

 সব পাইরেট অপরাধী নয়

সব পাইরেট নিজেদের তৈরী নিয়ম মেনে চলতো। নিজেদের কর্মকান্ডের জন্য শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন ব্যতীত অন্য কাউকেই জবাবদিহি করতে হতো না। আবার এক ধরনের পাইরেট ছিল, যারা সরকারের আদেশ মেনে চলত। এদেরকে ‘প্রাইভেটির’ বলা হতো। তাদের কাজ ছিল সরকারী যেকোনো মিশন পূর্ন করা। অটোম্যান সাম্রাজ্যের ভাড়া করা ‘বারবারি কোরসেয়ার্স’ একজন বিখ্যাত প্রাইভেটির। ডানকার্করাও প্রাইভেটির হিসেবে দারুণ ছিল, তারা স্প্যানিশ রাজতন্ত্র রক্ষা করতে অবদান রেখেছিল। ১৬১৬ সাল থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত ডানকার্ক প্রাইভেটিররা প্রায় ১৪৯৯টি জাহাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেয় এবং প্রায় ৩৩৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

 বর্তমানেও পাইরেটের অস্তিত্ব 

পাইরেটদের সোনালী দিনের গল্প শোনে বর্তমানের মানুষ অবাক হয়, ট্রেজার আইল্যান্ড পড়ে তারা তৎকালীন পাইরেটদের প্রেমেও পড়ে। কিন্তু পাইরেট শুধুমাত্র ১৭ কিংবা ১৮ শতকের দিকেই ছিল না। পাইরেট ছিল তারও পূর্বে থেকে। গালফ অব এডেন, মাদাগাস্কার, স্ট্রেইট অব মালাস্কা সবসময়ই পাইরেটদের স্বর্গরাজ্য ছিলো। বর্তমান পৃথিবীতেও পাইরেটদের অস্তিত্ব রয়েছে। ২০০০ সালের দিকে পাইরেটদের অস্ত্র হাতে ছোট-বড় বহর নিয়ে বানিজ্যিক জাহাজ আক্রমন করতে দেখা যায়।

দ্য রিচেস্ট অবলম্বনে 

9 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here