টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া দৌড়ে পার করেছেন যিনি!

8
248

ফিচারটি যখন লিখা হচ্ছে তখন তাকে নিতান্তই কৌতুহল থেকেই জিজ্ঞেস করছিলাম- “আচ্ছা নেক্সট এডভেঞ্চার কবে?”

তিনি বললেন,  ‘এখন যাচ্ছি বাংলা চ্যানেল সাঁতার কাটতে।’

অবাক না হয়ে পারলাম না। কারণ, “নেক্সট” বলতেই আমরা বুঝি বহুদূরের ভবিষ্যৎ ভাবনা। কিন্তু মানুষটা যখন জানালেন তার “নেক্সট” শুরু হচ্ছে ঠিক এই মুহুর্তেই তখন অবচেতন মন তাকে স্বেচ্ছায় শুভ কামনা জানালো। উল্লেখ্য, এর আগেও তিনি দুই দুইবার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন।

মানুষটার নাম মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আরাফাত। রিমেম্বার দ্যাট নেম! তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি দৌড়ে দৌড়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার শেষ সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছেন! এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এই দৌড় শুরু করেন টেকনাফের নোয়াপাড়া পরিবেশ টাওয়ার এলাকা থেকে। ২০ দিনে প্রায় ১ হাজার ৪ কি.মি রাস্তা পাড়ি দিয়ে ০৬ মার্চ তেতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে এসে পৌঁছান।

এত কিছু থাকতে দৌড়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যাওয়ার এই ইউনিক চিন্তা কিভাবে আসে আপনার মাথায়?

‘পৃথিবীতে এই দৌড়গুলো আল্ট্রা রান হিসেবেই পরিচিত। এই আল্ট্রা রানে আসল বিষয় হলো নিজের সামর্থ্যটা যাচাই করা।কারো সাথে কোন প্রতিযোগিতা নয়, বরং নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। দিনশেষে যা একজন মানুষকে করে আরো বেশি কনফিডেন্ট। ব্যাপারটা আমার জন্য ব্যতিক্রম ছিল না। আমি চেষ্টা করেছি যে মানবিক সামর্থ্যের একটা পরীক্ষা নিতে। তাছাড়া আমাদের দেশে ম্যারাথন  দৌড়টি পরিচিত না, যার জন্য আমরা পাচ্ছি না আন্তর্জাতিক মানের কোন দৌড়বিদ। আমার টার্গেট ছিল মানুষকে সুস্থতার বিষয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া, যাতে করে মানুষ তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে পারে।’

শামসুজ্জামান আরাফাত এই দৌড়ে মানবিক সামর্থ্যের পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিলেন। নির্মানাধীন সড়কে দৌড়ানো ভীষণ কষ্টের ছিল। তাছাড়া মহাসড়কে ধেয়ে আসা যানবাহনের ঝুঁকি ছিলো। এর মধ্যে একবার হাঁটুতে ইনজুরিও হয়েছিলো। কিছু জায়গায় পুলিশি জেরার মুখেও পড়তে হয়েছে। সবচেয়ে সমস্যা পড়তে হয়েছে যমুনা সেতু অতিক্রম করতে গিয়ে। যমুনা সেতুর উপর দিয়ে এভাবে দৌড়ানোর নিয়ম নেই। তাই প্রায় ঘন্টা দেড়েক যমুনার সেতুর নিচে নদীতে সাঁতরে পার হয়েছিলেন তিনি!

এই দৌড়ের মাধ্যমে তিনি এটিকে এডভেঞ্চার স্পোর্টস হিশেবে পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে ম্যারাথন দৌড় ওভাবে পরিচিত না। ইভেন্টও হয় খুব কম। সুইমিং চ্যানেলে সাঁতার কাটাও একটা জনপ্রিয় ইভেন্ট। বাংলাদেশে বাংলা চ্যানেল (টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন) আছে, যা পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ একটি ওপেন ওয়াটার সুইমিং চ্যানেল। কিন্তু প্রচারের অভাবে এটিকে সবার মাঝে তুলে ধরা যাচ্ছে না। তিনি এসব নিয়েই কাজ করতে চান। বিদেশে এ ধরনের খেলাধুলা ও ইভেন্ট খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও এইধরনের স্পোর্টস ও ইভেন্ট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হবে বলে বিশ্বাস করেন শামসুজ্জামান আরাফাত।

আপনি হাজার কি.মি পথ পাড়ি দিয়েছেন এই যাত্রায়। সারাদেশের সৌন্দর্য আপনাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মানুষের সাহায্য ও আতিথেয়তা পেয়েছেন। এই বাংলাদেশ নিয়ে আজকাল এত শংকা, এত নেগেটিভ হেডলাইন। আপনি যেহেতু পুরো দেশের ছোঁয়া কিছুটা হলেও একসাথে পেয়েছেন, সারাদেশের সেন্টিমেন্ট আপনার পক্ষে বুঝা সহজ।

–“আমার দেশের মানুষের একটি অনন্য গুন হচ্ছে কোন বড় টার্গেটের পেছনে এক হয়ে এগিয়ে আসা। সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। এটি আমাদের পুরো দেশেই বিরাজমান। আমাকে সাধারণ মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। অনেক সময় রাস্তার ধারে কোনো বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম অথবা রান্না করে খাওয়ার অনুমতি চেয়েছি। তারা শুধু অনুমতিই দেননি, আমাদের নানা ধরনের সাহায্যও করেছেন। আসলে নেগেটিভ হেডলাইন অনেক হলেও বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। আমাদের দেশের মানুষ খুবই আন্তরিক। আর সমগ্র বাংলাদেশকেই নতুনভাবে দেখেছি। রাস্তার দুই ধারের সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করেছে। এই যাত্রায় গোটা দেশকেই নতুনভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে!”

শামসুজ্জামান আরাফাত বারবার বলতে চাইলেন সুস্থতা কথা, সুস্বাস্থ্যের কথা। তার এই দৌড়ের স্লোগান ছিলো- “দ্যা গ্রেট বাংলাদেশ রান, রান ফর হেলদি বাংলাদেশ”। তিনি স্বপ্ন দেখেন ১৬ কোটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ মানুষের বাংলাদেশ। তিনি বলেন,

‘আমাদের দেশটা তো খুবই ছোট দেশ জনসংখ্যার তুলনায়। আর এই জনসংখ্যার বড় অংশই আমরা তরুণ। আমার দৌড়ের মূল বিষয়ই ছিলো সুস্বাস্থ্যময় তারুণ্য গড়ে তোলা। তরুণদের অনেকে মাদক গ্রহণ করেন। তারা যদি এসব ছেড়ে দৌঁড়ান, তাহলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন। একটু ভাবুন আমরা ১৬ কোটি সুস্থ মানুষ, দেখবেন তাৎক্ষনিকভাবে আপনার নিজের বুকটা ও গর্বে ভরে উঠবে। আর অদম্য মানসিকতাই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।’

তিনি যে সব ছেড়ে দিয়েই শুধু খেলাধুলা নিয়ে পড়ে আছেন এমন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। আর বর্তমানে কাজ করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে এডভেঞ্চার স্পোর্টসকে পরিচিত করাতে ও সুস্বাস্থ্যময় সচেতন তারুণ্যের প্রচারণা চালাতে কাজ করে যাচ্ছেন এই উদ্যমী তরুণ।

সারল্য ও স্বপ্ন তার চোখে মুখে। এই মানুষটাকে দেখলে মনে হয়, জীবন তার কাছে অনাবিল আনন্দের। এর রহস্য জানতে চাইলাম।

”আমি একটা বিষয় বিশ্বাস করি, একটা মানুষ তার নিজের সাথেই যুদ্ধ করবে। আমি তাই করি। আমি আমার চ্যাম্পিয়ন হয়ে থাকতে চাই সারাজীবন। আর কারো সাথে প্রতিযোগিতা নয়, নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।”

8 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here