থমাস মিজলে- বিশ্বের সবচাইতে নিকৃষ্ট বিজ্ঞানী?

22
307

১৮৮৯ সাল। আইফেল টাওয়ার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিনটেনডো, কোকাকোলা, এডলফ হিটলার- অনেক কিছুরই শুরু এই বছরটায়। আরেকজন মানুষেরও শুরু- ড. থমাস মিজলে, যার নাম খুব বেশি মানুষ হয়তো জানে না। অথচ তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক জে আর ম্যাকনেইল বলেছিলেন-

Midgley had more impact on the atmosphere than any other single organism in Earth’s history.

অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই একা এত বড় ইফেক্ট আর কোনো একক প্রাণী ফেলতে পারেনি!
তো কে ছিলেন এই থমাস মিজলে?

তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও কেমিস্ট। প্রায় ১০০টার উপর প্যাটেন্ট আছে তার নামে। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন সম্মানিত, প্রখ্যাত। তবে দুটো আবিষ্কারের জন্য তার লিগেসি অনন্তকাল ধরে উচ্চারিত হবে। এবং একই মানুষের দ্বারা এরকম দুটো জিনিসের আবিষ্কার, একটু বেশিই অদ্ভুত!

১৯২১ সালে ড. মিজলে আবিষ্কার করেন- ‘গাড়ির ফুয়েলে টেট্রাইথাইল লেড মেশালে সেটা ইঞ্জিনের নকিং প্রতিহত করে।’ এই আবিষ্কারের পর জেনারেল মটরস এটার প্যাটেন্ট শেয়ার কিনে নেয় এবং “লেড” অংশটুকু বাদ দিয়ে এটা ব্যাপক বাজারজাত করতে থাকে। লেড বা সীসা মানব জাতির জন্য খুবই ক্ষতিকর বিষ। মিজলের এই আবিষ্কারের পর সারা দুনিয়ায় সব ইঞ্জিনচালিত গাড়ি এই টেট্রাইথাইল লেড বা TEL মিশ্রিত ফুয়েল ব্যবহার করেছে ও বায়ুমন্ডলে এত বেশি সীসা ছেড়েছে নিষিদ্ধ করার আগে যে, সেটা সারা দুনিয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রকট প্রভাব ফেলে। এবং TEL এর ব্যবহার নিষিদ্ধের পর সেই ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাবও কেটে যাবার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা যায়। যদিও ১৯২৩ সালে এই আবিষ্কারের জন্য তিনি “নিকলস মেডেল” পান, অথচ একই বছর তিনি নিজেই সীসার কারণে অসুস্থ হয়ে সমস্ত কাজ থেকে ইস্তফা দেন! এদিকে এই TEL বানানোর কারখানায় মানুষ সীসার বিষক্রিয়ায় মারা যেতে থাকে। ব্যবসা বাঁচাতে ১৯২৪ সালে মিজলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সাংবাদিকদের সামনে TEL মিশ্রিত তেল নাকের কাছে ধরে ৬০ সেকেন্ড শ্বাস নেন- এটা যে ক্ষতিকর না সেটা প্রমাণের জন্য; তবে শেষ রক্ষা হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই TEL উৎপাদন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

১৯২০ সালের দিকে এই মিজলে ও তার দল জেনারেল মটরসের রেফ্রিজারেটরের জন্য একটা ভালো ওয়ার্কিং ফ্লুইড হিসেবে CFC বা ক্লোরোফ্লুরো কার্বন আবিষ্কার করে বসেন। তখনকার সময় ব্যবহৃত অন্যান্য রেফ্রিজারেন্ট যেমন অ্যামোনিয়া, ক্লোরোমিথেন, সালফার ডাই অক্সাইড ইত্যাদি ছিলো প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ, বিষাক্ত ও বিস্ফোরক টাইপের। সেই তুলনায় CFC অনেক বেশি নিরাপদ, কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হলো। এটা বিক্রিয়া করে না সহজে, বিস্ফোরক বা দাহ্য না। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৩৭ সালে “পারকিন মেডেল” পান। এটা ফ্রিজ ছাড়াও এরোসোল, হেয়ার স্প্রে ইত্যাদিতেও প্রচুর ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে ১৯৭০-এর দিকে আবিষ্কার হয়, এই CFC আমাদের বায়ুমন্ডলে যে “ওজোনোস্ফেয়ার” আছে, যেটা আমাদের সূর্যের ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে বাঁচায়, সেটা নষ্ট করে ফেলছে, ভাইরাসের মতো। প্রতি ১২ বছরে মোট ওজোন স্তরের ৪% নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই CFC-এর জন্য। এখন এটার ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। খেয়াল করে দেখবেন- আমাদের ফ্রিজের গায়ে CFC free লিখা থাকে।

TEL ও CFC- দুটো ব্যবসায়িক ভাবে সফল কিন্তু মানুষ ও পরিবেশের উপর প্রচন্ড ক্ষতিকর ক্যামিকেলের আবিষ্কারক ড. মিজলের মৃত্যুটাও খুব আয়রনিক হয়েছিলো- তিনি poliomyelitis নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অচল হয়ে যান। তখন তিনি নিজেই দড়ি ও পুলি দিয়ে একটা সিস্টেম বা মেকানিজম তৈরী করেন, যাতে অন্যরা তাকে বিছানা থেকে তুলতে পারে। নিজের ডিজাইন করা এই মেশিনেই দড়িতে গলা পেঁচিয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পোয়েটিক জাস্টিস কি এটাকেই বলে?

জীবনকালে তিনি প্রচন্ড সুনাম কুড়িয়েছিলেন, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি তাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরষ্কার- প্রিস্টলি মেডেল দেয়। এরপর তিনি উইলার্ড গিবস পুরষ্কারসহ আরো দুটো অনারারি ডিগ্রী পান, ১৯৪৪ সালে নির্বাচিত হন আমেরিকান ক্যামিকেল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে। অথচ পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস তাকে মনে রাখবে- “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ”, এই তর্কে রসদ জোগানোর মতো সবচেয়ে কুখ্যাত ও ক্ষতিকর দুটো উপাদানের আবিষ্কারক হিসেবে!

22 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here