বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করলো যে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন!

21
326

আমরা শেয়ার করা জাতি। ছোটবেলা থেকে আমাদের অনেককিছু অ্যাডজাস্ট বা শেয়ার করে চলতে হয়। আপনি বাবা মার একমাত্র সন্তান, হুট করে জানতে পারলেন সংসারে আপনার নতুন আরেকটি ভাই বা বোন এসেছে- ব্যাস, বিছানা শেয়ার করতে হবে তার সাথে। বাসে করে স্কুলে যাচ্ছেন, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে- একটি সিটে চাপাচাপি করে আরেকজনের সাথে বসে পড়লেন। বাবার কিনে আনা একটা চকলেট বা একটা পিজা আমরা সবাই শেয়ার করে খাই বা খেয়েছি। বড় সন্তানের জামা ছোট হয়ে গেলে সেটা ছোট সন্তান পড়েছে।

পরীক্ষায় নকল পর্যন্ত শেয়ার করে করেছে বাঙালি- শুধু নিজে পাশ করলে হবে না, সাথের জিগরি দোস্তকেও পাশ না করে এক্সাম হল থেকে বের হবে না- এমন নিদর্শনও রয়েছে। ছোটবেলা থেকে শুরু হওয়া এই শেয়ারিং বা অ্যাডজাস্ট বা চাপাচপি আমরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। যদিও বিটিভির পুরনো একটা টিউবওয়েলের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল- যতই চাপাচাপি কর না কেন, কোন লাভ নাই। লাভ লোকসান নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না, আমরা চাপতে, চাপাতে এবং চাপা মারতে ভালোবাসি।

এই শেয়ার করা কিউট জাতিটা ফেসবুক আসার পরে শেয়ারিং জিনিসটাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেল। যা দেখে তাই শেয়ার করে। সাড়া সপ্তাহ সানি লিওনের ছবিতে লাইক দিয়ে শুক্রবার হাদিসের পোস্ট শেয়ার করে বলে- জুম্মা মোবারক।

তবে এই শেয়ারিংয়ে যে সমস্যাটা হল, বাঙালি কিছু অদ্ভুত মানুষকে রাতারাতি “স্টার” বানিয়ে দিল। হিরো আলম, হলিপু, হাতিপু- অদ্ভুত সব ক্যারেক্টার। ১০ বছর ধরে থিয়েটার করা ছেলেটা একটা পাসিং শট পায় না, আর শেয়ার এর বদৌলতে এরা এক একজন পারলে সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপন সব করে ফেলে বা ফেলেছে।

সমস্যাটা হচ্ছে, যে বাঙালি একসময় একটা ভাল সিনেমা দেখলে বা একটা ভালো নাটক দেখলে শেয়ার করে ফাটায় ফেলতো বা জোর করে বন্ধুদের সেই সিনেমা দেখার জন্য নিয়ে যেত- সেই বাঙালি এখন সেটা করে না। তারা আমূলে পরিবর্তিত হয়েছে। উদ্ভট, কিম্ভূতকিমাকার, যৌন সুড়সুড়ি দেয়া জিনিস তারা সমানে শেয়ার করে; কিন্তু ডিফারেন্ট কিছু জিনিস শেয়ার করবে না। আবার দিনশেষে তারাই বলবে যে ভালো কোন কাজ একদম হচ্ছে না।

জুঁই নারিকেল তেলের একটি অ্যাড বের হয়েছিল বেশ কিছুসময় আগে। একজন মেয়ে পার্লারে চুল কাটাতে আসে, বারবার চুল কাটবার পরেও সে বলে- আরও ছোট করেন। একসময় নারী নাপিত জিজ্ঞাসা করেন- আর কত ছোট? তখন সেই মেয়েটি চোখে জল নিয়ে হাত মুঠো করে চুল ধরে বলে- এত ছোট যেন এভাবে ধরা না যায়। যে চুল নারীর সৌন্দর্য, সেটা যেন তার দুর্বলতার কারণ না হয়। হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় থেমে গিয়েছিল যখন প্রথম বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলাম, তখন।

অতি সিম্পল একটি দৃশ্য দিয়ে এই বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি যে শারীরিক নির্যাতন করা হয়, সেটি দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূল আইডিয়া ছিলও তানভির হোসেইনের, সাথে ছিলেন লেখক কিঙ্কর আহসান ও আরও অনেকে। পরিচালনায় ছিলেন আশুতোষ সুজন, অভিনয়ে ছিলেন সুমি নামের একজন মেয়ে; এই সুমিকে আবার সিলেক্ট করেছিলেন সুজনেরই স্ত্রী। সব মিলিয়ে অসাধারন একটি কাজ হয়েছে। পরিমাণ পাওয়া গেল ভিডিওটি কয়েকদিনের মাঝে ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে। তবে আরও অনেক কিছু অপেক্ষা করছিল এই কাজটির পেছনে।

ভারতের এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ভারতের জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ রজনিকান্ত ভার্সেস সিআইডি জোকস, নেপাল, ভুটান, নিউইয়র্ক টাইমস- এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এই বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বলা হয়নি। সব জায়গায় তুমুল প্রশংসা করা হয়েছে এই কাজের। বিজ্ঞাপন নিয়ে বিখ্যাত ফেসবুক পেজেও এই বিজ্ঞাপন শেয়ার করা করা হয়েছে যেটা অবিস্মরণীয় একটা অর্জন।

সারা দুনিয়ার অর্ধেক জায়গায় যে কাজটি এত সাড়া ফেলে দিল, সেটা নিয়ে আমাদের শেয়ার করা কিউট জাতির প্রধান মিডিয়াগুলো একদম চুপ! প্রথম সম্ভবত কালের কণ্ঠে দেখেছিলাম এটা নিয়ে রিপোর্ট হতে, সুমি মেয়েটার একটা ইন্টার্ভিউ ছাপানো হয়েছিল- কিন্তু বাকিদের তেমন কোন পাত্তাই নাই! সেলুকাস!

আমি বিশ্বাস করি না যে কেউ এটা বলবে- দেড় মিনিটের একটা বিজ্ঞাপন নিয়ে আর কি এমন রিপোর্ট করা যাবে? এত কীসের কথা বলেন আপনি? তিন ঘণ্টার সিনেমা হলে একটা কথা ছিল। আসলে ইচ্ছা থাকলে দেড় মিনিটের বিজ্ঞাপন নিয়ে চাইলে অনেক কিছু লেখা যায়। পরিচালকের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার, মডেলকে কীভাবে নির্বাচিত করা হলো, মডেলের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার, যেখানে শুটিং করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের অনুভূতি, স্ক্রিপ্ট রাইটারদের কথা, ক্যামেরায় যিনি ছিলেন তার বক্তব্য, জুঁই কোম্পানির যিনি প্রধান, তার সাথে কথা বলা- কী করা যায় না বলেন? কিন্তু কিচ্ছু হয় না, জাস্ট ইচ্ছা নাই অথবা ধরেই নেয়া হইছে যে- বাংলাদেশে আর কীই-বা ভালো কাজ হবে?

কারিনার রুটি বানানোর খবর কিংবা আলিয়ার কোন ধরনের সেক্স পজিশন পছন্দ, এই ধরনের নিউজে সয়লাব দেখি প্রিন্ট আর অনলাইন ভার্সন। সেটা নিয়া আমার তেমন কোন সমস্যা নাই। সমস্যা হচ্ছে- আমরা কি এমন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছি কিনা যাতে ক্লাস ফাইভে পড়া একটি ছেলে, আলিয়ার এই সেক্স পজিশনের খবর দেখলে সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে? সেটা নেয়ার মতো পর্যাপ্ত যৌনশিক্ষা তার কি আছে এই প্রশ্নফাঁসের যুগে? সেই দায়িত্ব কে নেবে? গণমাধ্যমের দায়িত্ব কি শুধু পাবলিক যা “খায়”, সেটাই খাওয়ানো? তাহলে জনগণের রুচি ঠিক করে দিবে কে? সেক্ষেত্রে কি গণমাধ্যমের কোন দায়িত্ব নাই?

অনেক কথা বলে থুক্কু লিখে ফেললাম। অনেক আশা আর হতাশা মিলিয়ে। শেষ করব অবশ্যই আশার সংবাদ দিয়ে। জুঁই নারিকেল তেলের এই বিজ্ঞাপনটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। পারলে এই ধরনের খবরগুলো নিজেদের আশেপাশের মানুষদের সাথে শেয়ার করেন। শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং।

21 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here