বিশ্বের যে হ্যাকারস’রা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন

11
304

হ্যাকার! শব্দটি শুনতেও এমন লাগে যে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোও বলবে এটা কি না কি অদ্ভুতুরে জিনিস! হ্যাকার বললে সাধারনতই আমাদের মনে চলে আসে চুরি করার বিষয়টি। হ্যাকার মানেই হচ্ছে ডিজিটাল চোর বা ডাকাত!! এই ধারণা আজ অধিংকাশ মানুষদের মধ্যে! কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। সব ধরণের কমিউনিটিতে যেমন ভালো এবং খারাপ দুই ধরণের মানুষ থাকে ঠিক তেমনই হ্যাকিং জগতেও এই ভালো বা খারাপ পক্ষগুলো আছে।

ভালো পক্ষকে White hat hackers আর খারাপ পক্ষকে Black hat hackers বলা হয়ে থাকে। Black hat hackers রা তাদের হ্যাকিং স্কিলকে বেআইনি কাজে ব্যবহার করে থাকেন। আজকের টিউনে আমি বিশ্বের কয়েকজন বিখ্যাত (এবং কুখ্যাত) হ্যাকারদের কথা বলতে এসেছি যারা তাদের হ্যাকিংয়ের জন্য পত্রিকার সংবাদের হেডলাইন হয়েছেন। তাদের মধ্যে কারো সৎ উদ্দেশ্য ছিলো আবার কারো ছিলো অসৎ খেয়ালীপনা। কেউ হয়তো টাকার জন্য, কেউ ব্যক্তিগত এবং সরকারি তথ্য হাতানো জন্য কিংবা কেউ বিনা কারণেই বড়সড় ধরণের হ্যাকিং করে বিভিন্ন সময় পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন।  তো চলুন চলে যাই আজকের টিউনে আর পরিচিত হই তাদের সাথে:

হেক্টর জাভিয়ার মনসিগুর (sabu):

Hector Xavier Monsegur ওরফে Sabu হলেন কুখ্যাত ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারস গ্রুপ LulzSec এর ফাউন্ডার। এই LulzSec গ্রুপটি বিভিন্ন সরকারি এবং কর্পোরেট ওয়েবসাইটে হ্যাক করে অনুপ্রবেশ করেছিলো আর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করেছিল শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য!!

সাবুকে গ্রেফতারের পর জনসম্মুখে তার পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে FBI তাকে দুটি অফার প্রস্তাব করেছিল: তাদের হয়ে কাজ করতে হবে অথবা ২৬ বছরের জেল খাটতে হবে! সাবু FBI এর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায় এবং তার LulzSec টিমের সাথে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টিমের অন্যান্য সদস্যদের আইনের মুখোমুখি করান। এজন্য তাকে ৭ মাসের মতো জেল খাটতে হয়েছে। ২৬ বছরের চেয়ে ৭ মাস জেল খাটা অনেক উত্তম প্রস্তাব, কি বলেন আপনারা?

কেভিন মিটনিক:

Kevin Mitnick হলেন হ্যাকিং জগতের একজন লেজেন্ড! তিনি কম্পিউটার আধুনিক জগতে প্রবেশের আগে থেকেই হ্যাকিং চর্চা করতেন। তিনি ১৯৭৮ সালে ১৫ বছর বয়সে সর্বপ্রথম সোসিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে হ্যাকিং শুরু করেন। তখনকার সময়ে তিনি পাঞ্জ কার্ড হ্যাক করে শহরের সকল বাসে ফ্রিতে রাইড করতে পারতেন। উনার প্রথম কম্পিউটার হ্যাকিংটি Digital Equipment Corporation এর কম্পিউটার সিস্টেমের উপর ছিল। অনুপ্রবেশের কারণে তার ১২ মাসের জেল এবং ৩ বছরের নজরবন্দীর সাজা হয়। তিনি তার ৩ বছরের নজরবন্দীর পরিমাণকে পুলিশ সার্ভারে হ্যাক করে ৫ মাসে কমিয়ে আনেন এবং ম্যালফাংশনের সাহায্যে মাত্র ৫ মাস মত জেল খেটে বেরিয়ে আসেন!

পরবর্তীতে হ্যাকিং জগতে তিনি অনেক কিছুই করেছেন। যেমন ক্লোন সেলফোন ব্যবহার করতেন তার লোকেশন এবং পরিচয় গোপন রাখার জন্য, বড় বড় সেলুলার এবং কম্পিউটার কোম্পানির সার্ভারে তথ্যের জন্য হ্যাক করতেন। তবে তিনি সর্বশেষে ৫ বছরের জেল খাটেন এবং হ্যাকিং জগত থেকে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি Mitnick Security Consulting নামের কম্পিউটার সিকুরেটি ফার্ম চালান।

গ্যারি ম্যাক’কিনন (solo):

মার্কিন মিলিটারিতে দুনিয়ার সবথেকে জখন্য কম্পিউটার হ্যাকের জন্য স্কটল্যান্ডের এই Gary McKinnon কে পত্রিকার শিরোনাম হতে হয়ে অনেকবার। তিনি ৯৭ মার্কিন মিলিটারী কম্পিউটার সার্ভারে এবং নাসার সার্ভারে চরম হ্যাকিং চালান ২০০১ এবং ২০০২ এর মাঝামাঝি সময়ে। তখন ৯/১১ ঘটনার তান্ডব চলছিল পৃথিবীতে আর ঠিক তখনকার সময়েই তিনি মার্কিন মিলিটারী সার্ভারে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিসাধন করেছিলেন।

যেমন নৌবাহিনীর খাবারের অর্ডারকে বিনা কারণে আটকে রাখা, কম্পিউটারগুলোতে এন্টি-আমেরিকান তথ্য প্রদর্শন করা ছাড়াও কম্পিউটার থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলিকে তিনি মুছে দিতেন। তবে তাকে গ্রেফতারের পর জানা যায় যে তিনি Asperger Syndrome নামক একটি অটিজম টাইপের মানসিক রোগে ভুগছেন। আর জবানবন্দিতে তিনি জানান যে তিনি শুধুমাত্র UFOs এর প্রমাণ খোঁজার জন্য আর এন্টি গ্রাভিটি টেকনোলজি ও ফ্রি এনার্জি সাপ্রেশন টেকনোলজির তথ্য খোঁজার জন্য হ্যাকিং চালিয়েছিলেন।

তিনি প্রায় ২৪ ঘন্টার জন্য আমেরিকার মিলিটারী সার্ভারের প্রায় ২০০০ কম্পিউটারকে অকেজো করে রেখেছিলেন। এছাড়াও ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের এট্যাকের পর তিনি Earle Naval Weapons Station এর অস্ত্রের লগ ফাইলসহ বহু গুরুর্ত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস ডিলেট করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও মিলিটারী সার্ভারে নিজের ইচ্ছেমত হামলার অর্ডার দিয়ে তিনি অনেক বড়সড় ক্ষতির চেষ্টাও করেছিলেন। যদিও এর আগেই তিনি গ্রেফতার হন। তার অসুস্থার কারণে তার ১০ বছরের জেল ছাড়া তেমন কোনো সাজা হয় নি। হ্যাকিং দুনিয়ায় তিনি UFO Hacker নামে পরিচিত।

ইহুদ টেনেনবাউম:

১৯৯৮ সালে ১৯ বছর বয়সে ইজরাইলি হ্যাকার Ehud Tenenbaum তার হ্যাকিং গ্রুপ নিয়ে নাসা, আমেরিকান এবং ইজরাইলি মিলিটারির কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাকিং করে অনুপ্রবেশ করেন। তারপর দুটি দেশের মিলিটারী সার্ভারে কৌশলে হ্যাক চালিয়ে তিনি এমন সিস্টেম তৈরি করেন যে, মনে হবে আমেরিকার বিরুদ্ধে এই অনলাইন এট্যাকটি ইজরাইল সরকার চালিয়েছি। তাকে গ্রেফতারের জন্য আমেরিকান সরকার Solar Sunrise নামের একটি মিলিটারি টিম গঠন করেন এবং ২০০১ সালে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। তার ১৮ মাসের জেল হলেও তিনি ৮ মাস পর বেরিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৮ সালে আবারো গ্রেফতার হন ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার চুরির অভিযোগে।

জোনাথান জেমস (c0mrade):

মাত্র ১৫ বছর বয়সে Jonathan James কে গ্রেফতার করা হয় বেলসাউথ এবং মায়ামি-ডেড স্কুল সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের জন্য। এই ঘটনার তদন্তে পরবর্তীতে জানা যায়, তার কাছে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্সের পুরো একটি ডিভিশনের সকল কম্পিউটারগুলো তথ্য রয়েছে। তিনি চাইলেই হাজারখানের মার্কিন মিলিটারী কর্মকতার মেসেজ পড়তে পারতেন।

এছাড়াও তিনি নাসাতে হ্যাক চালাতে সক্ষম হন এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের লাইফ সার্পোট সিস্টেমের সোর্স কোড চুরি করে নেন। এই ঘটনার জন্য নাসাকে তাদের সকল কম্পিউটার সিস্টেমকে ৩ সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখতে হয় এবং প্রায় ৪১ হাজার মার্কিন ডলারের (৩৩ লক্ষ টাকার) ক্ষতি পোহাতে হয়। এই সব ঘটনার জন্য তার ৭ মাসের কারাদন্ড ভোগ করতে হয় পরবর্তীতে ২০০৭ তার বিরুদ্ধে ক্রেডিট কার্ড চুরির অভিযোগ আনা হলে তিনি ২০০৮ সালে আত্মহত্যা করেন।

এডওর্য়াড স্নোডেন:

আমেরিকানদের উপর NSA এর গোপন গুপ্তচর প্রোগ্রামটি জনসম্মুখে ফাঁস করে দেবার জন্য Edward Snowden হ্যাকিং দুনিয়ায় পরিচিতি লাভ করেন। NSA কোম্পানি আমেরিকানদের উপর বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক হারে গুপ্তচর (spying) প্রক্রিয়া চালাচ্ছিন আর তখনই এডওর্য়াড গোপন প্রমাণপত্রগুলো NSA কম্পিউটার সার্ভার থেকে হ্যাক করে পাবলিকের সামনে ফাঁস করে দেন। বলা বাহুল্য যে তখন তিনি NSA এর সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ছিলেন। তাই তার হ্যাকিং কার্যক্রম তেমন কারো চোখে পড়তো না। ফাঁসের পর তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানে তিনি রাজনৈতিক বসবাসের অনুমতি পেয়ে যান।

Andrew Auernheimer (weev):

weev হলে একজন গ্রে হ্যাট হ্যাকার এবং ইন্টারনেট ট্রলিস্ট। তিনি সর্বপ্রথম আমাজন ওয়েবসাইটে হ্যাকিং চালিয়ে সবার নজরে আসেন। তিনি মূলত ট্রলিং (trolling) এর জন্য হ্যাকিং করতেন আর ম্যালওয়ার ছড়াতেন। তিনি ২০১০ সালে AT&T ওয়েবসাইটে হ্যাকিং চালিয়ে অনেকগুলো আইপ্যাড ব্যবহারকারির ইমেইল চুরি করতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে সেলিব্রিটি আর মিলিটারী লোকজনও ছিলো। তিনি হ্যাকিং করে তথ্যগুলো একটি নিউজ এজেন্সিতে ফাঁসের জন্য নিয়ে গেলে সেখানে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং আদালত তাকে ৪১ মাসের কারাদন্ড প্রদান করেন।

জুলিয়ান অ্যাস্যাঞ্জ (Mendex):

বর্তমান যুগে আমরা প্রায় সবাই Julian Assenge কে চিনি উইকিলিকস এর নির্মাতা এবং পাবলিক ফেস হিসেবে। কিন্তু এর অনেক আগে ৮০ দশকের শেষ দিকে ১৬ বছর বয়সে তিনি Mendex নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি এবং আরো দুজন হ্যাকার মিলে Internation Subversives নামের একটি হ্যাকিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উইকিলিকসের আগেও ১৯৯১ সালে ২০ বছর বয়সে মার্কিন ডিফেন্স সিস্টেম, নাসা সহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হ্যাকিংয়ের জন্য গ্রেফতার হন। তবে তার ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ছিলো না বলে তিনি কম সাজা পান।

জার্মি হ্যামন্ড:

Jeremy Hammond ছিলেন মূলত একজন রাজনীতিবিদ। তিনি তার কম্পিউটার দিয়ে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতে বিভিন্ন বেআইনি কাজ করতেন। এছাড়াও তিনি HackThisSite নামের একটি ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে বিভিন্ন হ্যাকারদের দরকারী সব টুলস দিয়ে দক্ষ হ্যাকার হবার সাহয্য করা হতো এবং বিভিন্ন হ্যাকিংয়ের নিলাম বসতো। তার এই ওয়েবসাইটের জন্য তিনি ঘন ঘনই পুলিশি ঝামেলায় পড়তেন।

পরবর্তীতে ২০১২ সালে একটি প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্স ফার্মে হ্যাকিংয়ের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন এবং তার ১০ বছরের সাজা হয়। তার বিরুদ্ধে এছাড়াও উইকিলিস কে তথ্য পাচার সহ চুরি করা ক্রেডিট কার্ডের লক্ষ লক্ষ ডলার বিভিন্ন চ্যারিটিকে প্রদানের অভিযোগ আনা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলে Jeremy Hammond কে Sabu হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে গ্রেফতার করে। Sabu হ্যাকার সম্পর্কে এই টিউনের একদম শুরুতে বলা হয়েছিল।

দ্যা জেস্টার (th3j35t3r):

দ্যা জেস্টার নামের হ্যাকার হচ্ছেন একজন স্বঘোষিত গ্রে হ্যাট হ্যাকার। তার আসল পরিচয় এখনো কেউ জানতে পারে নি। তিনি WikiLeaks, 4chan, Iranian Gov Website সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হ্যাকিং হামলার জন্য পরিচিত। তিনি তার নিজের তৈরি DoS টুল “XerXes” এর মাধ্যমে হ্যাকিং চালান। তাকে DoS (denial of service) script পদ্ধতির আবিস্কারকও বলা হয়।

তিনি এখনো টুইটারে একটিভ রয়েছেন এবং মাঝে মাঝেই তিনি টুইটও দিচ্ছেন। জেস্টার এর সম্পর্কে এটুকু জানা গিয়েছে যে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত একজন সৈনিক ছিলেন।  তবে এখন পর্যন্ত তার পরিচয় কেউ ফাঁস করতে পারেনি বিধায় বর্তমান যুগে তাকে হ্যাকিং গড বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

কেমন লাগলো আজকের পোস্টটি ? আশা করি ভালোই লেগেছে। আজকের হ্যাকার লিস্টের প্রায় সবাই NASA সার্ভারে হ্যাক করতে সক্ষম হয়েছেন। নাসা সার্ভারে হ্যাকিং করা দুনিয়ার সবথেকে কঠিন হ্যাকিং কাজ! তাহলে বুঝুন তারা কি লেভেলের হ্যাকার! পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

11 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here