বিল গেটসকে টপকে গেছেন অ্যামাজনের জেফ বেজোস…

12
487

ই তো গত মাসের কথা। ১৭ জুলাই সকালে মার্কিন মুলুকের অর্থবাজার যখন সবে খুলেছে, তখন দেখা গেল একজনের সম্পদের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ফলাফল, সম্পদের দিক থেকে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে টপকে গেছেন তিনি। এই তিনি মানে অ্যামাজন ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস তখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়ার তাবৎ গণমাধ্যমে। তবে জেফের কপালে ‘শীর্ষ ধনী’ খেতাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ওই দিনই শেয়ারবাজারে পড়ে যায় অ্যামাজন ডটকমের শেয়ারের মূল্য। আবার বিল গেটস এক নম্বর আর জেফ বেজোস শীর্ষ ধনীর তালিকায় ফিরে গেলেন দুই নম্বরে।

‘অ্যামাজন’ শব্দটা শুনলে একসময় মনে ভেসে উঠত দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন অববাহিকার ছবি। আর এখন? নদী আর বনাঞ্চলের বদলে ভেসে ওঠে কমলা-কালো একটা লোগো। পৃথিবীতে এখন ডিজিটাল রূপান্তরের সময়। এই ডিজিটাল রূপান্তর (ট্রান্সফরমেশন) নিয়ে যেকোনো সেমিনার বা আলোচনায় প্রথম যে উদাহরণটি দেওয়া হয়, সেটি অ্যামাজন ডটকমের। বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রেতা অ্যামাজন, কিন্তু এর কোনো দোকান নেই। ২৩ বছর আগে (৫ জুলাই ১৯৯৪) জেফ বেজোস ইন্টারনেটভিত্তক বই কেনাবেচার ওয়েবসাইট হিসেবে যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই অ্যামাজন ডটকম এখন সব ধরনের পণ্য বিক্রি করে। পৃথিবীজুড়েই চলে অ্যামাজনের পণ্য বিকিকিনি। প্রকৃতির বিশাল-বিপুল বিস্ময় অ্যামাজনের মতোই তথ্যপ্রযুক্তি জগতের বিস্ময় অ্যামাজন ডটকম।

স্ত্রী ম্যাকেনজি বেজোসের সঙ্গে জেফ বেজোস। এই দম্পতির রয়েছে চার সন্তান। ছবি: সংগৃহীতবর্তমানে ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সম্পদের অধিকারী জেফ বেজোস জন্মেছিলেন জেফরি প্রেসটন জর্জেনসেন নামে। নিউ মেক্সিকোতে জ্যাকলিন ও জর্জেনসেন দম্পতির ঘরে ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি জেফের জন্ম। জেফের মা-বাবার সংসার এক বছরও টেকেনি। ছোটবেলাতেই টেক্সাসে নানাবাড়িতে চলে আসেন জেফ বেজোস। জেফের বয়স যখন চার, তখন তাঁর মা জ্যাকলিন বিয়ে করেন মিগুয়েল মাইক বেজোসকে। এই সৎবাবার বংশ পদবিই ব্যবহার করতে থাকেন জেফ বেজোস।

শীর্ষ ধনী কিংবা সফল ব্যক্তিদের অনেকের বেলায় যেমনটা দেখা যায় একেবারে সাধারণ জায়গা থেকে উঠে আসা, জেফের বেলায় ব্যাপারটা তেমন নয়। জেফ যখন ছোট, মা জ্যাকলিনের পরিবারের জমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার একর। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জমি এবং পরে নিজের কেনা জমি মিলিয়ে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে জেফ বেজোস হয়ে ওঠেন টেক্সাসের সবেচেয়ে বেশি পরিমাণ জমির মালিক।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই দেখা যায় জেফ বেজোসের মধ্যে। ছোট ভাইবোনের জন্য এটাসেটা দিয়ে একটা অ্যালার্ম ঘড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের নানা আয়োজনে অংশ নিতেন নিয়মিত। ১৯৮৬ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক হন জেফ বেজোস। স্নাতক হওয়ার পর জেফের পেশাজীবন শুরু হলো। তবে তা জমিজমা বা অ্যামাজন ডটকম দিয়ে নয়; প্রভাবশালী শেয়ারবাজার ওয়াল স্ট্রিটে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি বড় বড় কোম্পানির কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করতেন। এরপর দু-একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যামাজন ডটকম।

ব্যবসা পরিচালনা, নতুন উদ্যোগের পরিকল্পনা—কাজের ক্ষেত্রে জেফ বেজোসের নিজস্ব একটা স্টাইল রয়েছে। অ্যামাজন শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটলে গাড়ি চালিয়ে যান জেফ। আর সেটা নাকি ছিল অ্যামাজনের ব্যবসা পরিকল্পনার একটা অংশ। নিজের বাড়ির গ্যারেজেই শুরু করেছিলেন অ্যামাজনের কাজ।

জেফ বেজোসজেফ বেজোস সেই বিরল সিইওদের একজন, যিনি সব কর্মী নিয়োগের সময় ইন্টারভিউ বোর্ডে নিজে উপস্থিত থাকেন। অ্যামাজনের প্রথম এক দশকে এই নিয়মের তো কোনো ব্যতয়ই ঘটেনি। প্রযুক্তির সংবাদভিত্তিক অনলাইন গণমাধ্যম ওয়্যারড ২০০০ সালের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়। অ্যামাজনের প্রত্যেক কর্মীর নিয়োগ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকতেন প্রতিষ্ঠানের সিইও। তিনি সাদা বোর্ডে নিয়োগপ্রার্থীর জন্য নানা প্রশ্ন, তথ্য-উপাত্ত লিখে রাখতেন। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। অ্যামাজনের একজন সাবেক কর্মী বলেছিলেন, জেফ সব সময় চাইতেন নতুন যে কর্মী যোগ দেবেন অ্যামাজনে, তাঁর দক্ষতা ও মেধা অন্যদের থেকে হবে বেশি। আবার পরে যে কর্মী আসবেন, তাঁকে আগের কর্মীর মেধাকে টেক্কা দিয়ে আসতে হবে।

নিজের ব্যবসায় উদ্যোগকে শুধু অ্যামাজনেই আটকে রাখেননি জেফ। ২০১৩ সালে কিনে নেন বিশ্বখ্যাত পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ২০০০ সালে একেবারে অন্য রকম প্রতিষ্ঠান গেড়ন জেফ। ব্লু অরিজিন নামের এই প্রতিষ্ঠান যাত্রীবাহী মহাকাশযান তৈরি করে। মহাকাশে বিলাসবহুল হোটেল, পার্ক, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি বানানোর কাজে লেগে আছে জেফের এই প্রতিষ্ঠান। গুগলে বিনিয়োগ রয়েছে জেফ বেজোসের। প্রযুক্তিভিত্তিক সাড়া জাগানো উদ্যোগে বেজোস এক্সপিডিশন নামে বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন বেজোস। আংশিক হলেও বেজোসের বিনিয়োগ আছে এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকায় টুইটার, উবার, এয়ারবিএনবি থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অ্যামাজনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানও কম নয়। অ্যালেক্সা ইন্টারনেট, এ নাইন ডটকম ইত্যাদি আছে এই তালিকায়।

অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও নিয়েছেন জেফ। ২০১৬ সালে স্টার ট্রেক বিওয়াইন্ড-এ অভিনয় করেন।

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেফের ‘টু পিৎজা রুল’ নিয়ে বেশ কথা হয়। অফিসে জেফ যে সভাগুলো করেন, সেখানে যে কজনই উপস্থিত থাকুক না কেন, তাঁদের আপ্যায়নের জন্য দুটি পিৎজা আর পানীয় থাকবে। দুটি পিৎজার কমও না বেশিও না। লোক বেশি হলে ওই দুটি পিৎজা ভাগ করে খেতে হবে। আর কম হলে একেকজন বেশি বেশি পিৎজা খেতে পারবেন। জেফ বিশ্বাস করেন, এ দুই পিৎজার নিয়মে নাকি উৎপাদনশীলতা বাড়ে।

নিজের মতো করে ব্যবসা চালিয়েই তো আজ জেফ বেজোস বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। অ্যামাজন ডটকমের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সব দেশে, সব অঞ্চলে।

12 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here