ক্যাটাকম্ব- পৃথিবীর একমাত্র লাশের জাদুঘর!

9
430

ইতালির সিসিলি শহর। এই শহরের একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। নিয়মটা এমন যে, শহরের যে সকল ধনী মানুষজন ছিলেন তারা মারা গেলে তাদেরকে সাধারণ ভাবে সমাধি দেয়া যাবে না। তাদের জন্যে ছিলো এক অভিনব পদ্ধতি। মৃত লাশকে সুন্দর, আকর্ষণীয় পোশাকে সাজানো হতো। এই সাজানো লাশগুলোকে না দেয়া হতো কবর, না পুড়িয়ে ফেলা, কিছুই না! বরং, লাশগুলোকে নিয়ে রাখা হতো, মৃতদেহ সংরক্ষণাগারে। শহরের ক্যাটাকম্বে লাশ সংরক্ষণাগারের দেয়ালে মৃতদেহগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হতো। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এটাই পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর, যেখানে লাশ শুধুমাত্র লাশ সংরক্ষণ করা হয়েছে!

ইতালির সিসিলি শহর, ক্যাটাকম্ব, লাশের জাদুঘর

১৯২০ সাল পর্যন্ত সিসিলি শহরের ধনী মানুষের লাশের জন্যে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। প্রায় তিনশ বছর ধরে এই কাজটি তারা করে এসেছে।

কেউ মারা গেলে প্রথমে তাকে একটি বিশেষ ঘরে রেখে দেয়া হয় এক বছর ধরে। এটি করার কারণ হচ্ছে, এর ফলে লাশের দেহ থেকে সব জলীয়বাষ্প বের হয়ে যেতো এই প্রক্রিয়ায়। এরপর লাশকে রোদে শুকানো হয়। তারপর মৃতদেহটিকে পুরোপুরি মমি বানানোর জন্যে ভিনেগারে ভিজিয়ে রাখা হয়। সর্বশেষ ধাপে মমিগুলোকে জামাকাপড় পরিয়ে দাঁড় করিয়ে কিংবা বসিয়ে রাখা হতো “ক্যাটাকম্ব” নামের সংরক্ষণাগারে। কাপড়গুলো দেখলে হয়ত মনে হবে এসব পুরানো আমলের নোংরা কাপড়। কিন্তু খুব খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, লেস দেয়া এই কাপড়গুলো একসময়কার সবচেয়ে দামি কাপড়।

মৃতদেহগুলোর গলায় ঝোলানো থাকে তাদের নাম পরিচয়। কারো কারো গলায় আছে তাদের বেঁচে থাকাকালীন ছবি। যদিও, অনেকদিন এভাবে পড়ে থাকার কারণে, কিছু কিছু নাম মলিন হয়ে গিয়েছে।

ক্যাটাকম্বে আছে হরেক রকমের লাশ। সবচেয়ে বড় চমক “রোজেলিয়া লোম্বার্ডো” নামের দুই বছর বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের মমি। মেয়েটা মারা যায় ১৯২০ সালে। তার বাবা ছিল চিকিত্সক। তিনি রোজেলিয়ার মৃতদেহে ইঞ্জেকশন দিয়ে একটি কাচের কফিনে তা সংরক্ষণ করেন। তবে অবাক করার মতো কথা হচ্ছে, আপনি যদি মেয়েটির কফিনের দিকে তাকান, তাকে মৃত মনে হবে না। মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগে এই শিশুটিকে পরম মমতায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

ইতালির সিসিলি শহর, ক্যাটাকম্ব, লাশের জাদুঘর

জাদুঘরটি রক্ষণাবেক্ষণ করেন এখানকার কিছু ধর্মযাজক। জায়গাটা কতটা ভয়ংকর, শিহরণ জাগানিয়া ভেতরে না ঢুকলে আপনি টেরই পাবেন না। দুপুরের পর খুব কম সময়ের জন্যে এখানে আসেন পর্যটকরা। তাছাড়া পর্যটকদের জন্যে নেই গাইড বই, জাদুঘর সম্পর্কে নেই তেমন কোনো তথ্য, নেই কোনো সতর্কবানীও। আসলে, ধর্মযাজকরা এই জায়গাটিতে পর্যটকরা বেশি পরিমাণে আসুক এটা চাননা। কিন্তু, ধর্ম প্রচারের অর্থ, ও জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্য অর্থ জোগাতে কিছু সময়ের জন্য পর্যটকদের ভেতরে আসার অনুমতি দেয়া হয়।

কেউ এই জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে, যত সাহসী হোন না কেনো একটু হলেও গাঁ শিউরে উঠবে, ভয় ভয় লাগবে। একই সাথে আতঙ্ক, বিস্ময়ে গাঁ ছমছম করে উঠতে পারে। কারণ, ভেতরে ঢুকেই আপনি দেখবেন আপনার চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। সত্যিকারের লাশ।

লাশগুলো মোমের জাদুঘরের মতো নকল লাশ নয়। মমির মতো কফিনে ঢাকা লাশও না। হাত বাড়ানো দূরত্বে সারি করে বেঁধে রাখা লাশ, যেনো চাইলেই ছুঁয়ে ধরা যাবে। অনেকেই লাশ দেখে হতবাক হয়ে যান, কেউ চিৎকার করেন। কেউ কেঁদে উঠেন।

ইতালির সিসিলি শহর, ক্যাটাকম্ব, লাশের জাদুঘর

অনেকে আবার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দিয়ে দেখে কৌতূহলবশত লাশ এর কাপড়ে হাত ছোঁয়ান। পর মুহুর্তেই যখন বুঝতে পারেন এটি আসলেই সত্যিকারের লাশ তখন ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে হাত সরিয়ে ফেলেন! নানান বিপদ আছে এই ক্যাটাকম্বে। এ শত শত মৃতদেহের মাঝে এসে আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে যান অনেকেই।

ক্যাটাকম্বে প্রথম যে লাশটি সংরক্ষণ করা হয়েছিলো সেটি এক ফাদারের। তারনাম ফাদার সিলভেস্ত্রো দ্য গাবিও। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৫৯৯ সালে। সেই সময়ে আরো চল্লিশ জন সন্ন্যাসীর লাশও সংরক্ষিত হয় সেখানে।

প্রচলিত আছে, সেই সময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সন্ন্যাসীরাও আক্রান্ত হন প্লেগ রোগে। তারা রোগে ভুগে মারা যান এই ক্যাটাকম্ব শহরে। ওই ঘটনার পর থেকেই ক্যাটাকম্ব পরিচিত হয়ে ওঠে পবিত্র এক জায়গা হিসেবে। তৎকালীন ধনী অভিজাত ব্যক্তিরা তখন উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তারা চান তাদের আত্মীয় কিংবা নিজেদের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহকেও যেন এই পবিত্র স্থানে সংরক্ষিতকরা হয়। এভাবেই কালক্রমে ক্যাটাকম্ব হয়ে ওঠে গোরস্তানের দামি বিকল্প!

9 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here