আলোখেকো গ্রহের খোজ মিলল এই প্রথম

12
293

দারুণ ‘খাই খাই’ স্বভাব তার! আর কিছু খাক বা না খাক, আলো সে খাবেই!

গবগব করে আলো গিলে নিচ্ছে দৈত্যাকার একটা গ্রহ! পুরোপুরি উদরস্থও করে নিচ্ছে!

তার রাক্ষুসে খিদে এতটাই যে, সেই গ্রহ থেকে আলো প্রায় বেরিয়ে আসে না বললেই চলে। আর আলো বেরিয়ে আসতে পারে না বলে সেই ভিন গ্রহের গায়ের রং মিশমিশে কালো। আদ্যোপান্ত পিচের মতো। মহাকাশের এই সদ্য আবিষ্কৃত ‘কৃষ্ণ’ অনেকটা ব্ল্যাক হোলের মতো।

অনেকটা, কারণ ফারাক রয়েছে। ফারাক এইটুকুই, ব্ল্যাক হোল যা কাছে পায়, তা-ই খায়। তা সে আলোই হোক বা কোনও কণা বা কোনও মহাজাগতিক বস্তু। তার অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষ বল আশপাশের সব কিছুকেই উদরস্থ করে।

সেই আলোখেকো গ্রহ ‘ওয়াস্প-১২বি’। দেখুন ভিডিও

হাবল টেলিস্কোপে তোলা সেই আলোখেকো গ্রহ ‘ওয়াস্প-১২বি’ (ডান দিকে)

আর এই যে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ভিন গ্রহটির হদিশ মিলেছে, সে তার নক্ষত্রের ফেলা আলোর প্রায় পুরোটাই (৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশ) খেয়ে ফেলে। আলোই তার এক ও একমাত্র ‘খাদ্যবস্তু’! তবে সেই আলো খায় গ্রহটির অত্যন্ত ঘন বায়ুমণ্ডল। ব্লটিং পেপারের মতো গ্রহটির বায়ুমণ্ডল প্রায় সবটুকু আলোই শুষে নেয়।

 

মহাকাশের এই ভিন গ্রহটির আয়ু কিন্তু খুব বেশি নয়। কারণ, তার বায়ুমণ্ডল আর তার শরীরের অংশ একটু একটু করে খেয়ে নিচ্ছে তার জন্মদাতা নক্ষত্র। ফলে এক দিন তার জন্মদাতা নক্ষত্রের সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় আত্মবলি দিতে হবে ভিন গ্রহটিকে।

দুই মূল গবেষক নিকোলাস বি কাওয়েন (বাঁ দিকে) ও টেলর জেমস বেল

সেই নক্ষত্রটির নাম- ‘ওয়াস্প ১২’। আর সেই নক্ষত্রটিকে পাক মেরে চলেছে যে ‘আলোখেকো’ ভিন গ্রহটি, তার নাম- ‘ওয়াস্প-১২বি’। এখনও পর্যন্ত যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভিন গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, ‘ওয়াস্প-১২বি’ই তার মধ্যে একমাত্র ‘আলোখেকো গ্রহ’। এমন আজব গ্রহের হদিশ এর আগেনি মেলেনি ব্রহ্মাণ্ডে।

গ্রহটি অবশ্য পৃথিবী থেকে অনেকটাই দূরে। আলোর গতিতে ছুটলে ‘খাই খাই’ করা সেই ভিন গ্রহটিতে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগবে ১ হাজার ৪০০ বছর। সেটি রয়েছে ‘অরিগা’ নক্ষত্রপুঞ্জে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপে প্রথম ওই গ্রহটির হদিশ মিলেছিল ২০০৮ সালে। পরে নাসার স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ, চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরিও সেই গ্রহটির অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছে।

সেই ‘কৃষ্ণ’ ভিন গ্রহ। দেখুন ভিডিও

তবে সেই গ্রহটির যে এমন ‘খাই খাই’ স্বভাব রয়েছে, হাবল স্পেস টেলিস্কোপের ইমেজিং স্পেকট্রোগ্রাফে তা ধরা পড়েছে একেবারে হালে। আর সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে গত ১৪ সেপ্টেম্বর। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ। যার শিরোনাম- ‘দ্য ভেরি লো অ্যালবেডো অফ ওয়াস্প-১২বি ফ্রম স্পেকট্রাল একলিপ্স অবজারভেশন উইদ হাবল’।

ভিন গ্রহটি সম্পর্কে সবিস্তার জানতে মূল দুই গবেষক কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল ফেলো টেলর জেমস বেল ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিকোলাস বি কাওয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল আনন্দবাজারের তরফে।

ওই ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ গ্রহটির চেহারা, চরিত্র কেমন?

আনন্দবাজারের তরফে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মূল গবেষক টেলর জেমস বেল ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা ওই ভিন গ্রহটি চেহারায় আমাদের বৃহস্পতির দ্বিগুণ। আক্ষরিক অর্থেই দানব গ্রহ! গ্রহদের জাতে এরা ‘হট জুপিটার’। বৃহস্পতি বা তার চেয়ে বড় আকারের হলেও এরা আদতে গ্যাসে ভরা গ্রহ। আমাদের বৃহস্পতির মতোই। পৃথিবী, মঙ্গলের মতো পাথুরে গ্রহ নয়। তবে ‘ওয়াস্প-১২বি’ গ্রহটি বৃহস্পতির মতো তার নক্ষত্র থেকে অতটা দূরে নয়। বরং সেই ভিন গ্রহটি তার নক্ষত্রের খুব কাছেই রয়েছে। এত কাছে যে পৃথিবীর একটা দিনেই তার এক বছর হয়ে যায়! মানে, ওই ভিন গ্রহটি তার নক্ষত্রের চার পাশে পাক মারছে বনবন করে। অসম্ভব গতিবেগে।’’

সেই নক্ষত্র আর তার সামনে ‘কৃষ্ণ’ গ্রহ ‘ওয়াস্প-১২বি’ (কালো) 

পৃথিবীর মতো ‘ওয়াস্প-১২বি’র আবর্ত গতি নেই। আর নক্ষত্রের অত কাছে আছে বলেই ‘ওয়াস্প-১২বি’র একটা দিক সব সময় থাকে তার নক্ষত্রের দিকে। আর অন্য দিকটি থাকে তার নক্ষত্রের ঠিক উল্টো দিকে। ফলে, ভিন গ্রহটির একটা দিক সব সময় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তার নক্ষত্রের আলো, তাপে। আর অন্য দিকটা সব সময়ই ঢাকা থাকছে জমাট কালো অন্ধকারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকেই বলে ‘টাইড্যালি লক্ড’ অবস্থা। পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদ রয়েছে যে ভাবে।

হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে ‘ওয়াস্প-১২বি’র যে দিকটা সব সময় তার নক্ষত্রের দিকে থাকে, তার তাপমাত্রা ৪ হাজার ৬০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আর যে দিকটা সব সময় থাকে নক্ষত্রের উল্টো দিকে, তা তুলনায় অনেকটা ঠান্ডা। সেখানকার তাপমাত্রা ২ হাজার ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো।

কেন আলো গবগব করে খেয়ে ফেলে ‘ওয়াস্প-১২বি’?

অন্যতম গবেষক ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিকোলাস বি কাওয়েন ই-মেলে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, “আগে হাবলের পাঠানো তথ্য খতিয়ে দেখে জানতে পেরেছিলাম, ‘ওয়াস্প-১২বি’র যে দিকটা তার নক্ষত্রের উল্টো দিকে থাকে সব সময়, সেই দিকটা তুলনায় ঠান্ডা হওয়ায় সেখানকার বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে জলীয় বাস্প জমে। মেঘের জন্ম হয়। সেই মেঘ ভেসে বেড়ায়। কিন্তু এ বার জানতে পেরেছি, গ্রহটির যে দিকটা সব সময় থাকে তার নক্ষত্রের ঠিক সামনে, সেই দিকে প্রচণ্ড তাপে জলীয় বাষ্প সঙ্গে সঙ্গে উবে যায় বলে মেঘ জন্মাতেই পারে না। গ্রহটি রয়েছেও তার নক্ষত্রের খুব কাছে। মাত্র ২০ লক্ষ মাইল দূরে।

চেহারায় বৃহস্পতির দ্বিগুণ এই ‘ওয়াস্প-১২বি’ (ডান দিকে)

মেঘ হয় বলেই সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসা আলো প্রতিফলিত হতে পারে। তাই মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখতে লাগে নীলাভ। অন্য ভিন গ্রহগুলিকেও দেখা যায় তাদের মেঘ আলোর প্রতিফলন ঘটায় বলে।

বেলের কথায়, ‘‘একেবারেই মেঘ জমতে পারে না বলে ‘ওয়াস্প—১২বি’র যে দিকটা তার নক্ষত্রের দিকে থাকে সব সময়, সেই দিকটা থেকে আলো প্রতিফলিত হতে পারে না। আলোর ৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশই গিলে নেয় গ্রহটি। বরং নক্ষত্র থেকে আসা আলো তার অত্যন্ত ঘন বায়ুমণ্ডল ফুঁড়ে তার পৃষ্ঠভাগে (সারফেস) পৌঁছে যায়। আর সেই আল‌োকে শুষে নেয় গ্রহটির বায়ুমণ্ডল ও পিঠের ওপরে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি। তাতে প্রচণ্ড তাপশক্তির জন্ম হয়। তাই গ্রহটির পিঠ বা সারফেসও অসম্ভব রকমের গরম।’’

এমন আজব গ্রহের হদিশ এই প্রথম, বলছেন বিজ্ঞানীরাই

টেলর জেমস বেল ও নিকোলাস কাওয়েন দু’জনেই বলেছেন, ‘‘এমন আজব গ্রহের হদিশ এর আগে মেলেনি। চেহারায় বৃহস্পতির মতো গ্যাসে ভরা গ্রহগুলি সাধারণত তার ওপর পড়া আলোর ৪০ শতাংশের প্রতিফলন ঘটায়। ফলে উজ্জ্বলতা কম হলেও সেই গ্রহগুলিকে আলো ঠিকরোতে দেখা যায়। কিন্তু ‘ওয়াস্প-১২বি’ একেবারেই অন্য রকম। এমনকী, বায়ু তেমন জোরে বয় না বলে নক্ষত্রের দিকে মুখ করে থাকা গ্রহটির পিঠ থেকে অন্য দিকের পিঠে পুরো তাপটা যেতে পারে না। ফলে, গ্রহের একটা দিক সব সময় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়।’’

বড়জোর আর ১০ লক্ষ বছর তার আয়ু!

হাবলের পাঠানো তথ্য এর আগে জানিয়েছিল, খুব কাছে থাকায় ‘ওয়াস্প ১২’ নক্ষত্রটি ধীরে ধীরে খুবলে বের করে নিচ্ছে তার গ্রহ ‘ওয়াস্প-১২বি’র শরীরের অংশ।

তার পর এক দিন তার নক্ষত্রের গর্ভেই চলে যেতে হবে রাক্ষুসে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ এই গ্রহটিকে।

তার আগে পর্যন্ত মহাকাশের এই ‘কৃষ্ণ’-এর সর্বগ্রাসী ক্ষুধার হাত থেকে রেহাই মিলবে না আলোর!

12 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here