বিপিএলে বিদায়ী তিন দলের ‘ভরাডুবি’র কারণ

22
499

দুপুর একটা থেকে রাত দশটা অবধি গত একমাসে যে ক্রিকেট সিরিয়াল ছিল দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে, বিপিএলের সেই আসর প্রায় শেষের পথে। গ্রুপ পর্ব থেকে এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছে তিনটি দল। শুক্রবারের এলিমিনেটর থেকেও বাদ যাবে আরো একটি দল। আসর শুরুর আগেই কাগজে কলমে অনেক দলই ছিল শীর্ষ চারের দৌড়ে। কিন্তু টুর্নামেন্ট গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি দলের শক্তি ও দুর্বলতা। কোনো দলে হয়ত বিদেশিরা ভালো করেছেন, কোনো দলকে হয়ত বিদেশিরাই হতাশ করেছেন।

দেশীয় ক্রিকেটাদের মধ্যেও অনেক তারকা ফ্লপ করেছেন, আবার নতুন কোনো মুখও উঠে এসেছে এবারের আসর থেকে। গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরা চিটগং ভাইকিংস, রাজশাহী কিংস আর সিলেট সিক্সার্সের পারফরম্যান্স কেমন ছিল এবারের আসরে, কোথায় পিছিয়ে পড়েছিল তারা, কোথায়ই বা সম্ভবনার অপমৃত্যু হয়েছিল- সমকাল পাঠকদের জন্য সেটাই নেড়ে চেড়ে বিশ্নেষণ করা হয়েছে।


বোলিংয়েই ঢুবেছে চিটাগাং

মাত্র তিনটি ম্যাচ জিতে এবারের আসরে সবার আগে বিদায় নিয়েছে চিটাগং ভাইকিংস। অথচ এই দলটির যে ব্যাটিং গভীরতা ছিল তা দিয়ে সেরা চারে যেতেই পারতো। কিন্তু শুরুতে মিসবাহ উল হকের মতো সিনিয়র পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের শ্নথগতির ব্যাটিংয়ের কারণে ভুগতে হয়েছে তাদের। চারটি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা মিসবার স্ট্রাইক রেট ছিল ৯১.২০, যা কিনা টি-টোয়েন্টির র সঙ্গে বড্ড বেমানান। প্রথম ম্যাচেই চিটাগাং কুমিল্লার বিপক্ষে ১২ ওভারে ২ উইকেটে একশ’র ওপর রান তোলে। অথচ তাদের ইনিংস শেষ হয় মাত্র ১৪৩ রানে।

চিটাগাং কিংসের হয়ে নিয়মিত ওপেন করা সৌম্য সরকার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। ১১ ম্যাচ খেলে ১৬৯ রানে তার স্ট্রাইক রেট একশোর নিচে! পরের দিকে ওয়ান ডাউনে নামা এনামুল হক বিজয়ের স্ট্রাইক রেট অবশ্য ভালো ছিল ১২৮.৭৫। মূলত বিদেশিদের দিয়েই চিটাগংয়ের ব্যাটিং সাজানো ছিল। সেখানে জিম্বাবুয়ের সিকান্দার রাজার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৫৩.৫৯, স্টিয়ান ফন জিলের ১৩৫.৭১, নাজিবুল্লাহ জাদরানের ১৪৪.৮২। তবে সবার চেয়ে বেশি ১৬৯.৮৪ স্ট্রাইক রেটে ১১ ম্যাচে ৩২১ রান করে লুক রনকি ছিলেন চিটাগাংয়ের প্রাণ। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দেড়শোর ওপর রান তুলেছিল দলটি।

তবে চিটাগাংয়ের বোলররা ব্যাটসম্যানদের পুঁজি রক্ষা করতে পারেনি বেশিরভাগ ম্যাচেই। মূলত স্থানীয় বোলারদের দিয়েই চিটাগংয়ের বোলিং অ্যাটাক সাজানো ছিল। ঠিক এখানটাতেই মার খেয়েছে তারা। তাসকিন ১১ ম্যাচে ১৪ উইকেট পেলেও ওভার প্রতি ৯.৩৪ রান দিয়েছেন! স্লগ ওভারগুলোতে বেশিরভাগ ম্যাচেই দলকে হতাশ করেছেন। কিন্তু তারপরও তাকেই প্রতিটি ম্যাচ খেলানো হয়েছে। লেগস্পিনার তানভীর হায়দারও নয়ের ওপর রান দিয়ে দশটি ম্যাচই খেলেছেন। পেসার শুভাশিষের ইকোনমিও ছিল নয়ের ওপর, যদিও তাকে মাত্র পাচটি ম্যাচ খেলানো হয়েছিল। ব্যর্থ হয়েছেন চিটাগংয়ের বিদেশি পেসার ক্রিস জর্ডান, লুইস রিকিরাও। মূলত বোলিংয় অ্যাটাকে বৈচিত্র্য না থাকার কারণেই চিটাগাং এবারের আসরে ব্যর্থ হয়েছে। আগামীবার হয়ত চিটাগং ভাইকিংসের মালিকানা বদল হবে। সেই সঙ্গে তাদের স্কোয়াডেও পরিবর্তন আসবে। টিম ম্যানেজমেন্ট নিশ্চয়ই তখন ব্যাটিং এবং বোলিং অ্যাটাকে সুন্দর কম্বিনেশন এনে দারুণ একটি দল গড়বে।


সিলেট: ফিনিশারের অভাব

যে দল টুর্নামেন্টের শুরুতেই ঘরের মাঠে টানা তিনটি জয় নিয়ে আলোড়ন তুলেছিল, সেই দলই কিনা শেষ নয়টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে! সিলেট সিক্সার্সের এমন পারফরম্যান্সে নিশ্চিত হতাশ হয়েছেন তাদের সমর্থকরা। কিন্তু কেন এমন হলো? আসলে প্রথম তিনটি ম্যাচেই তাদের দুই বিদেশি ওপেনার উপুল থারাঙ্গা আর আন্দ্রে ফ্লেচারের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে দলের ব্যাটিং গভীরতা মাপা যায়নি। তবে শেষ দিকে থারাঙ্গা দেশের হয়ে খেলার জন্য ফিরে গেলে সিলেটের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে। এই দলটির টপ অর্ডারে রান এলেও ফিনিশিংয়ের ঘাটতি ছিল। শেষ দিকে অন্যিান্য দলগুলো যেখানে ক্যারাবিয়ান হার্ডহিটারদের দিয়ে স্লগ ওভার মোকাবেলার চেষ্টা করেছে, সেখানে সিলেটের দেশীয় ক্রিকেটাররা সেটা পারেননি। মাত্র একটি ম্যাচে নুরুল হাসান সোহান শেষ ওভারে ছক্কা হাকিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিল। এর বাইরে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই স্লগ ওভারগুলোতে রান কম এসেছে সিলেটের।

সিলেটের হয়ে এবারের আসরে মোট একাশ’র ওপর রান করা কোনো ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট একশো ত্রিশের ওপর ওঠেনি। যেটি প্রমাণ করে দলটিতে হার্ডহিটারের অভাব ছিল। সাব্বির রহমান মোট ২১১ রান করলেও তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৫.৫৯। অথচ অনান্য দলে স্লগ ওভারের ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট ছিল দেড়শোর কাছাকাছি! বেশ কয়েকটি ম্যাচে সিলেটের শুরুটা ভালো হলেও শেষদিকে এসে ফিনিশারের অভাবে ম্যাচ জিততে পারেনি দলটি। তবে বোলিংয়ে সিলেটের দারুন বৈচিত্র্য ছিল। অধিনায়ক নাসির হোসেন নিজে বেশ কয়েকটি ম্যাচে নতুন বলে ওপেন করেছেন। ১২ উইকেট পাওয়া নাসিরের ওভারপ্রতি রান দেওয়ার গড় ছিল ৭.২৮। তাইজুলও দারুণ বোলিং করেছেন। এর বাইরে আবুল হাসান রাজু তার স্লোয়ার দিয়ে দারুণ বোলিং করেছেন পুরো আসরে। দশ উইকেট পেলেও তার ইকোনমি নয়ের ওপর যায়নি। তবে সিলেটের বিদেশি বোলররা কিছুটা হতাশ করেছেন। ক্রিসমার, লিয়াম প্লাঙ্কেট, টিম ব্রেসনান এবং শেষ দিকে সোহেল তানভীর- প্রত্যকেই নয়ের কাছাকাছি ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন। তবে সিলেটকে ভুগতে হয়েছে দু’একজন ফিনিশারের অভাবের কারণেই।


রাজশাহী: প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বিদেশিরা

লেন্ডল সিমন্স, ডোয়াইন স্মিথ, ড্যারেন স্যামি, কেসরিক উইলিয়ামস- টি ২০ বিশ্বক্রিকেটে পরীক্ষিত এসব ক্যারিবীয়দের দলে ভিড়িয়েছিল রাজশাহী কিংস। কিন্তু দলটির দুর্ভাগ্য বিদেশিরা তাদের প্রত্যাশা পূরন করতে পারেনি। তার কারণও রয়েছে। রাজশাহী কিংসের ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা প্রায় প্রত্যেকেই ইনজুরি আক্রান্ত ছিলেন। মাত্র তিন ম্যাচ খেলে সিমন্স চোট পান, ডোয়াইন স্মিথ খেলেন মাত্র দুই ম্যাচ- তাতেই তার স্ট্রাইক রেট ছিল দেড়শো। পুরো টুর্নামেন্টে স্যামি অধিনায়কত্ব করেছেন ইনজুরি নিয়ে। যদিও তিনি ৮ ম্যাচে ১৬৮.১৮ স্ট্রাইকে দলের হয়ে সব্বোর্চ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দলটির বাকি বিদেশিদের মধ্যে হতাশ করেছেন আগের বারের পারফর্মার ইংল্যান্ডের সামিত প্যাটেল। যদিও ৬ ম্যাচ খেলে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬৬.৬৬। কিন্তু সেটা শেষ দিকে এসে। তার আগে পুরো টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হয়েছেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান লুক রাইট। ৬ ম্যাচে তিনি ১৩৫ রান করেছেন স্ট্রাইক রেট মাত্র ১১২.৫০ তে! তবে রাজশাহী কিংসের দেশীয় ক্রিকেটাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। মুমিনুল ১২ ম্যাচে ২৩০ রান করেছেন ওপেনিংয়ে নেমে, যদিও তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১১১.১১। তবে জাকির হোসেন চমক দেখিয়েছেন। মাত্র আট ম্যাচে তিনি ১৪২.০১ স্ট্রাইক রেটে ১৬৯ রান করেছেন। সেই সঙ্গে রনি তালুকাদারও ১২১.৭৮ স্ট্রাইক রেটে কয়েকটি ম্যাচ দারুণ করেছেন।

কিন্তু একাদশে জাকির কিংবা রনি টানা ম্যাচে সুযোগ পাননি। রাজশাহীর আইকন ক্রিকেটার হয়েও প্রত্যাশা পূরন করতে পারেননি মুশফিক। সবগুলো ম্যাচ খেলে তার রান ১৮৫, স্ট্রাইক রেট ১২৬.৭১। ব্যাটিংয়ে দলটি ধারবাহিকতা না দেখাতে পারলেও বোলিংয়ে কিন্তু মন্দ ছিল না। বিশেষ করে মেহেদী হাসান মিরাজ। পুরো আসরে ১০ উইকেট পেলেও সাতের নিচে তার ইকোনমি ছিল। একই ধারবাহিকতা ছিল তাদের পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ সামিরও। যদিও তাকে সবগুলো ম্যাচ খেলানো হয়নি। ৯ ম্যাচে ১১ উইকেট নিলেও তার স্ট্রাইক রেট সাতের নিচেই ছিল। কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান শেষ দিকে এসে দলের সঙ্গে যোগ দিলেও প্রত্যাশা পূরন করতে পারেননি। পাঁচ ম্যাচে ৪ উইকেট শিকার করেছেন ওভার প্রতি ৮.৪০ রান দিয়ে। জেমস ফ্রাঙ্কলিন ওভার প্রতি ৮.৮৩ এবং কেসরিক উইলিয়ামস ওভারপ্রতি ৯.৭২ রান দিয়েছেন। বিদেশি বোলররা হতাশ করলেও রাজশাহীর হয়ে কাজী অনিক, হাসান আলীর মতো দেশীয় প্রতিভাবান পেসাররা ভালো করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটিকে ছিটকে পড়তে হয়েছে দেশি এবং বিদেশি তারকা ক্রিকেটারদের অফ-ফর্মের কারণেই।

22 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here