আস্থা হারাচ্ছে ফেসবুক

14
311

মাত্র ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার গেছে খোয়া! বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ২ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মাত্র এক দিনে শেয়ারবাজারে ঠিক এই পরিমাণ বাজারমূল্য হারিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর ওয়ালস্ট্রিটে নড়বড়ে হয়ে যায় ফেসবুকের অবস্থান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন অভিযোগে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে ফেসবুক। এতে একদিকে যেমন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির ওপর ব্যবহারকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ব্যবসায়িক সুনাম।

অভিযোগ উঠেছে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। ওই অ্যাপের মাধ্যমে কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। সেই তথ্য পরে ব্যবহার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের কাজে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত এক অধ্যাপক সম্প্রতি মুখ খোলায় প্রকাশ্যে এসেছে সবকিছু। এখন পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদেরা। তদন্তও শুরু হয়ে গেছে।

এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর গতকাল সোমবার ফেসবুকের শেয়ারের দামে ধস নামে। প্রতি শেয়ারের দাম ১৭২ ডলার ৫৬ সেন্টে নেমে গেছে। এক দিনেই ফেসবুকের শেয়ারের দাম কমেছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম এতটা কমে যাওয়া নজিরবিহীন। শুধু ফেসবুক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নাসদাকের শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। অ্যালফাবেট বা গুগলের শেয়ারের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাজনের দাম কমেছে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। অ্যাপলের প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে আগের চেয়ে ২ শতাংশ কম দামে। অন্যদিকে, মাইক্রোসফটের শেয়ারের দাম ২ দশমিক ২ শতাংশ কমে গেছে।

ফেসবুকের এই কেলেঙ্কারিতে সরব হয়েছেন সরকার ও রাজনীতির বাঘা বাঘা ব্যক্তি। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ ঘটনাকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার লন্ডন কার্যালয়ে তল্লাশি চালানোর অনুমতি চেয়েছে দেশটির তথ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় রাজনৈতিক দলের সিনেটররা তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে শুনানির ডাক দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যামি ক্লোবুশার ও রিপাবলিকান-দলীয় জন কেনেডি বলেছেন, তাঁরা শুনানিতে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। একই সঙ্গে অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলেছেন তাঁরা।

অভিযোগের মুখে গত শুক্রবার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বরখাস্ত করেছে ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, নিয়মভঙ্গকারী একজন গবেষকের কাছ থেকে ব্যবহারকারীদের তথ্য পেয়েছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা।

অভিযোগের আদ্যোপান্ত
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রথম এ বিতর্কের সূচনা হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিল তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেক্সান্ডার কোগানের তৈরি অ্যাপ্লিকেশন ‘দিসইজইওরডিজিটাললাইফ’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এর ফলে ব্যবহারকারীদের তথ্য জোগাড় করার সুযোগ পান ওই অধ্যাপক। ওই অ্যাপ মূলত একটি ব্যক্তিত্ববিষয়ক পরীক্ষা চালাত। কিন্তু যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই অ্যাপ ডাউনলোড করতেন, তাঁরা আলেক্সান্ডার কোগানকে নিজেদের বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার অনুমতিও দিতেন। এর ফলে ব্যবহারকারীদের অবস্থান, তাঁদের বন্ধু ও যেসব পোস্টে তাঁরা ‘লাইক’ দিতেন, সে সম্পর্কে জানতে পারতেন মনোবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপক। ওই সময় ফেসবুকের নিয়মনীতির মধ্যেও এ কার্যক্রম অনুমোদিত ছিল।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ব্যবহারকারীদের ওই তথ্যাবলি কোগান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে সরবরাহ করেন। ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গ করেই এ কাজ করেন তিনি। ফেসবুকের পাঁচ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর তথ্য এভাবে বেহাত হয়ে যায়।

ওই সময় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ভোটারদের প্রভাবিত করা যাবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১৫ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ওই সব তথ্য মুছে ফেলতে বলেছিল তারা। কিন্তু কয়েক দিন আগে জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠান জানতে পারে, ওই তথ্যভান্ডারের সবটুকু মুছে ফেলা হয়নি।

এদিকে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যে তথ্যের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরবরাহ করা হয়নি। তবে ট্রাম্প শিবিরকে সেবা দেওয়ার কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা।

নিউইয়র্ক টাইমস ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো মূলত কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কন্ট্রাক্টর ক্রিস্টোফার উইলির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

এত শোরগোল কেন?
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আলোচনায় আছে মিথ্যা সংবাদ প্রচার, সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণা ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়টি। এ নিয়ে কিছুদিন আগে মুখ খুলেছিলেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গও। তখন তিনি ‘ফেসবুক বাঁচানোর’ পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেছিলেন।

সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বিতর্কে ফেসবুকের ব্যবসাপদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ফেসবুক যেভাবে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য অ্যাপ ডেভেলপার ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে থাকে, সেটি তারা করতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জাকারবার্গের জন্য এখন অনেকগুলো প্রশ্ন অপেক্ষা করে আছে। ব্যবহারকারীদের তথ্য কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই ব্যাপারে ফেসবুক কি ব্যবহারকারীদের কাছে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পেরেছে? তৃতীয় পক্ষের কাছে তথ্য বেহাত হওয়া ঠেকাতে প্রতিষ্ঠানটি আরও কার্যকর পদক্ষেপ কি নিতে পারত?

রিপাবলিকান সিনেটর জেফ ফ্লেক সিএনএনকে বলেছেন, এটি একটি বড় বিষয়। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘনের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে, কে এটি জানে? কখন তারা জানতে পারল? কত দিন ধরে এসব চলেছিল?

বিশ্লেষকদের মতে, এসব প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া মার্ক জাকারবার্গের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে।

অস্তিত্বের সংকট?
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নতুন কেলেঙ্কারির কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ফেসবুক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। ব্যবহারকারীরা এখন ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা দোটানায় ভুগবেন। আর এর প্রভাব পড়বে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষক ম্যালকম ন্যান্স বলেন, ‘এখন যদি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি প্রগতিশীল ব্যবহারকারী ফেসবুককে প্রত্যাখ্যান করেন, তখন কী হবে? তাঁরা যদি বলে বসেন যে ট্রাম্প, রাশিয়া, নব্য নাৎসি ও বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী শক্তির উপকরণ বলেই ফেসবুক ব্যবহার করবেন না? ফেসবুক কর্তৃপক্ষের উচিত যত দ্রুত সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি উপশমে কাজ শুরু করা। তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে হাল আমলের তথ্যবিষয়ক কোনো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নয় তারা।’

সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো আলেক্সান্ডার কোগান যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা ফেসবুকের নীতিমালাতেই ছিল। ফেসবুক কর্তৃপক্ষও তা স্বীকার করেছে। আবার অ্যাপ ডেভেলপার ও বিজ্ঞাপনদাতারা যাতে তৃতীয় পক্ষের কাছে তথ্য হস্তান্তর করতে না পারে, তার জন্য কোনো সুরক্ষাব্যবস্থাও ফেসবুকের নেই।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১৪ সাল থেকে ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ একটি বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, ওই সব পদক্ষেপ তথ্যের বেহাত হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে যথেষ্ট নয়।

এত বিতর্কেও চুপটি করে রয়েছেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। মুখ খোলেননি তাঁর ডেপুটি শেরিল স্যান্ডবার্গও। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের হয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন একজন আইনজীবী। প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কেউ উত্তর দিচ্ছেন না একটি প্রশ্নের। ২০১৫ সালে তথ্য বেহাত হওয়ার কথা জানার পরও কেন এত দিন মুখ বন্ধ করে ছিল প্রতিষ্ঠানটি?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সমস্যার গোড়া কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বা রাশিয়ায় নয়, ফেসবুকের ভেতরই।

14 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here