ঠিক কি কারণে স্মার্টফোন’ একটি প্রযুক্তি পণ্য হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে এটার উত্তর যদি বলতে হয় তাহলে বলবো স্মার্টফোনে একক প্যাকেজ হিসেবে বিভিন্ন ফাংশন এবং প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন সমন্বয় ঘটানো হয়েছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে ।
এই পর্বে, আমরা স্মার্টফোনের প্রযুক্তি একত্রীকরণের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করতে যাচ্ছি ।
সেটি হচ্ছে, টাচ স্ক্রিন ডিসপ্লে।
টাচ স্ক্রিন ডিসপ্লে তিনটি প্রযুক্তি বিদ্যমান রয়েছে ।
১) Toughened Glass (শক্ত কাঁচ)
2) Capacitive Touchscreen (ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন)
3) OLED Display.(ওএলইডি ডিসপ্লে)
এই তিনটি প্রযুক্তি একে-অপরের সাথে যুক্ত করে একত্রিত করা হয়েছে । আপনি যখন প্রথমবারের মতো একটি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন, তখন আপনার মনে হতে পারে যে আপনি বৈপ্লবিক কিছু ধরে আছেন। যেটা কিনা আগের সব ফোনের থেকে আলাদা কিছু। কিন্তু টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি আসলে নতুন কোন প্রযুক্তি নয় ।
তো চলুন টাচস্ক্রিন ডিসপ্লে স্তর গুলো সম্পর্কে জেনে নেই ঃ
Toughened Glass (শক্ত কাঁচ):
টাচ স্ক্রিন ডিসপ্লের ঠিক উপরের স্তরে থাকে একটি শক্ত কাঁচ । এই শক্ত কাঁচটি আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮০০ সালের দিকে। স্মার্টফোনের গ্লাস, সাধারণ কাঁচের চেয়ে প্রায় ৫ গুন বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে। ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন দেখানোর আগে পর্যন্ত সেল ফোনের স্ক্রিনের মান ছিল প্লাস্টিক । যার ফলে স্ক্রিনে সহজেই স্ক্র্যাচ পড়তো ।
কীভাবে স্মার্টফোনে ব্যবহার করা এই শক্ত কাঁচকে শক্তিশালী করা হয়?
একটি স্মার্টফোনের গ্লাস মূলত একটি অ্যালুমিনো সিলিকেট গ্লাস যা গলিত পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে ভিজিয়ে শক্ত করা হয়।
এর ফলে কাচের সোডিয়াম পরমাণু গুলি স্থানান্তরিত হয়, এবং পটাশিয়াম পরমাণু গুলি তাদের জায়গা দখল করে নেয়। পটাশিয়াম পরমাণু আকারে সোডিয়াম পরমানুর চেয়ে বড়,তারা কাচের পৃষ্ঠে একটি উল্লেখযোগ্য সংবেদনশীল শক্তি উৎপন্ন করে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো সহজেই বুঝে নেইঃ
একটি প্রাইভেট গাড়ির পিছনের সিটে ৩ জন সাধারণ আকারের মানুষ সহজেই বসতে পারবে এবং নড়াচড়াও নিজেদের মধ্যে করতে পারবে । কিন্তু এই তিন জনের পরিবর্তে যদি মোটা সাইজের তিনজন বসানো হয়, তাহলে তারা খুব লাগালাগি ভাবে এটে যাবে কিন্তু নড়াচড়া তেমন ভাবে করতে পারবে না। এই এটে যাওয়া তিনজনকে সড়াতে তুলনামুলক ভাবে বেশি শক্তির প্রয়োজন হবে।
এটিই শক্ত কাচকে বিশেষ করে শক্তিশালী করে তোলের পিছনে মৌলিক ধারণা, পরমাণুগুলি সংকুচিত হয় তাই কাচটি ভাঙতে আরও বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় ।
Capacitive Touchscreen (ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন):
শক্ত এই কাঁচের ঠিক নিচেই রয়েছে ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন, এর মাধ্যমে পরিবাহী উপাদান যেমন, আঙুলের স্পর্শের অবস্থানের উপস্থিতি কে অনুভব করে।
এই টাচস্ক্রিনটি দুটি স্বচ্ছ ডায়মন্ড গ্রিড প্যাটার্ন দিয়ে গঠিত যার মাঝখানে থাকে একটি অপটিক্যাল ভাবে পরিষ্কার ইনসুলেটর যা পলিয়েস্টার দ্বারা মুদ্রিত। ডায়মন্ড গ্রিড প্যাটার্ন একটি স্বচ্ছ, ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড বা আইআইটিও নামের উপাদান দিয়ে মুদ্রিত হয় যা কন্ডাক্টর হিসাবে কাজ করে।
এটি কীভাবে কাজ করে তা আরও ভাল করে দেখা যাক,
বোঝার সুবিধার্থে ধরে নেই স্বচ্ছ ডায়মন্ড গ্রিড প্যাটার্নটির উপরের অংশ হলুদ এবং নিচের অংশ নীল । ডায়মন্ড গ্রিড প্যাটার্ন গুলোকে হীরা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ।
নীল হীরার উপর তৈরি হয় ইলেকট্রন, তবে পথে একটি অন্তরক বা ইন্সুলেটর থাকায়, ইলেকট্রনগুলি নড়াচড়া করতে পারে না। ইলেকট্রনগুলি একটি নেগেটিভ বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে যা হলুদ হীরার উপর একগুচ্ছ পজেটিভ চার্জ তৈরি করে এটাকে ক্যাপাসিটর বলা হয়।
এখন, যখন আমরা এই ক্যাপাসিটরের কাছে আমদের আঙুলের ডগা একটি পরিবাহী উপাদান হিসাবে রাখি,
এটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রকে ব্যাহত করে যা হলুদ হীরার উপর তৈরি হওয়া পজেটিভ চার্জের পরিমাণ পরিবর্তন করে।
হলুদ হীরার উপর এই ব্যাঘাতের কারণে পজেটিভ চার্জের পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়, এবং প্রসেসর এটি একটি স্পর্শ হিসাবে নিবন্ধন করে।
নীল হীরার সারি বরাবর চার্জ বা ভোল্টেজ স্ক্যান করে স্পর্শের অবস্থান সনাক্ত করা হয়,
পাশাপাশি প্রতিটি হলুদ হীরার কলাম সক্রিয়ভাবে পরিমাপ করা হয়।
নীল হীরার প্রতিটি সারি একসাথে সংযুক্ত থাকে,
এছাড়াও হলুদ হীরার প্রতিটি কলাম সংযুক্ত থাকে।
এই সেটআপ নীল কলাম এবং হলুদ সারির একটি গ্রিড তৈরি করে।
এই সমস্ত উপাদান স্বচ্ছ উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়।
প্রতিটি বিন্দু পরিমাপের জন্য খুব বেশি সার্কিটের প্রয়োজন, তাই কেবল প্রতিটি কলাম পরিমাপ করা হয়।
চার্জ বা ভোল্টেজ পরপর প্রতিটি সারিতে পাঠানো হয়, যাতে প্রসেসর একবারে একাধিক স্পর্শ নিবন্ধন করতে পারে
এর নীচের স্তরে রয়েছে একটি ডিসপ্লে যা এলসিডি বা ওএলইডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এলসিডি এবং ওএলইডি উভয়ই উচ্চ মানের চিত্র উৎপাদন করে,
এই পর্বে আমরা ওএলইডি প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করতে চলেছি কারণ এটি বেশিরভাগ নতুন স্মার্টফোনে ব্যবহৃত হয়।
OLED Display.(ওএলইডি ডিসপ্লে):
OLED পূর্ণরূপ Organic light emitting diode. এটি উচ্চ-রেজোলিউশনের ওএলইডি ডিসপ্লে যা হাই-কোয়ালিটি ছবি তৈরি করে, আমরা যখনই আমাদের স্মার্টফোনের দিকে তাকাই তখন আমরা দেখতে পাই। এটি একটি জটিল গ্রিড! বর্তমান ভালো মানের ফোন গুলোতে ৩.৩ মিলিয়ন পিক্সেল থাকতে পারে।
তার মানে আপনার হাতের তালুতে প্রায় ১০ মিলিয়ন আণুবীক্ষণিক পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রিত লাল, সবুজ এবং নীল আলো রয়েছে।
ওএলইডি ডিসপ্লে গুলি পৃথক পিক্সেল গুলির একটি বিশাল গ্রিড দিয়ে গঠিত এবং প্রতিটি পিক্সেল একটি লাল সবুজ, এবং নীল সাব পিক্সেল দিয়ে গঠিত।
প্রতিটি সাব পিক্সেল এর হালকা তীব্রতা একটি ছোট পাতলা ফিল্ম ট্রানজিস্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা একটি ডিমার সুইচ হিসাবে কাজ করে।
প্রতিটি সাব পিক্সেল অনেক স্তর যুক্ত কাঠামো আছে, ফোটনগুলি ইলেকট্রন দ্বারা সাবপিক্সেলগুলিতে উৎপাদিত হয় যা নেগেটিভ থেকে পজেটিভ টার্মিনালে চালিত হয়।
যখন তারা এখানে এই মধ্যস্তর দিয়ে যায়, যাকে ইমিসিভ লেয়ার বলা হয়, ফোটনগুলি শক্তি প্রকাশের মাধ্যমে নির্গত হয়।
ইমিসিভ লেয়ার তৈরি করতে ব্যবহৃত যৌগ গুলি নির্গত আলোর রঙ নির্ধারণ করে,
এবং এই আলোর তীব্রতা নির্ভর করে কতগুলি ইলেকট্রন অতিক্রম করে তার উপর।
এই ব্যাখ্যাটি ব্যাপকভাবে সরলীকৃত তবে ওএলইডির পিছনে গবেষণা, প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ব্যাপক।
আসলে পদার্থবিজ্ঞানে ২০১৪ সালের নোবেল পুরস্কার ৩ জন গবেষক কে তাদের নীল আলো নির্গমনকারী ডায়োড আবিষ্কারের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছিল!
সুতরাং, সংক্ষেপে বলি:
নীচের দিকে একটি ওএলইডি ডিসপ্লে যা ১০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র আকৃতির সামান্য রঙিন আলো দিয়ে গঠিত।
তার উপরে একটি স্বচ্ছ ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন রয়েছে যা একবারে এক বা একাধিক আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে পারে।
এবং তার উপরে শক্তিশালী কাচ রয়েছে যা আপনার স্ক্রিনকে আঁচড় এবং বেশিরভাগ পড়ে যাওয়ার পরেও রক্ষা করে।
এই পোস্টটি পড়ার পর, এখন আপনিও নিজেও একজন টাচস্ক্রিন বিশেষজ্ঞ!
আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তবে সেগুলি নীচের কমেন্ট বক্সে পোস্ট করুন।
আপনার বন্ধুদের বা পরিবারকে আপনার শেখা সম্পর্কে কিছু বলুন।
এই পর্বটি একটি টাচস্ক্রিন ডিসপ্লের কাঠামো সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আলোচনা করা হয়েছে।
এই পর্বের শাখাগুলি হল: মাল্টিটাচ ডিজাইন, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র, ক্যাপাসিটর
ওএলইডি এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ, এলসিডি, উপকরণগুলি স্বচ্ছ কেন? এবং ইন্টারফেসের নান্দনিকতা।
পোস্টি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পোস্ট পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি । অবশ্যই পোস্টি শেয়ার করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন ।